:: সাইয়েদ আবদুল্লাহ ::
নজরুলের পাশে যাকে দেখতে পাচ্ছেন, তার নাম উমা কাজী, সম্পর্কে কবির পুত্রবধু। নজরুলের জীবন এবং কর্ম নিয়ে নতুনকরে আর বলার কিছু নাই, সবকিছুই কালজয়ী। আজকে বরং নজরুলের পাশে থাকা এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। মূলত উমা কাজীকে নিয়ে ২০২০ সালে বিস্তারিত একটা লেখা লিখেছিলেন কলকাতার লেখক শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, উমার পরলোকগমনের পর তাকে ট্রিবিউট করে। তার সুবৃহৎ সেই লেখার বেশকিছু অংশ ধার করে এবং পরিমার্জনা করে আমি এই লেখাটি লিখছি।
বর্ধমানের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। পড়াশোনা করেছিলেন নার্সিং এর ওপর, এরপর কোলকাতার লেডি ডাফরিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ততোদিনে জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাক কবির স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিও লোপ পেয়েছে ইতোমধ্যে। বাঁধনহারা চিরবিদ্রোহী যেই কবি চষে বেড়িয়েছেন সবদিকে, সেই কবির জীবনের গন্ডি আঁটকে গেলো বাড়ির চারদেয়ালের মধ্যে।
কবিপত্নী প্রমীলাও ততোদিনে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তাহলে কবির সেবাযত্ন করবে কে? এজন্য বাড়িতে একজন সার্বক্ষণিক নার্সের দরকার পড়লো।
লেডি ডাফরিন হাসপাতালের হেডনার্সের পরামর্শে উমা সেই দায়িত্বটা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নজরুল ততোদিনে উভয় বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় নাম, তার সেবিকা হওয়ার মাঝেও একটা বড় গৌরব আছে।
বাড়িতে দেখতে গিয়ে কবির একদম মাথার কাছে বসলেন তরুণী উমা। কবিপত্নী প্রমীলা দেবী বললেন, “মা, তুমি কি পারবে কবির সেবা করতে? ওই যে দ্যাখো, উনি খবরের কাগজ ছিঁড়ছেন। উনি এখন শিশুর মতো।” এ প্রশ্নের উত্তরে উমা বললেন, “আমি তো কলকাতার হাসপাতালে শিশু বিভাগেই ডিউটি করি। কবি যদি শিশুর মতো হন, তবে নিশ্চয়ই পারবো।”
এরপর থেকে কবির সব দায়দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন উমা। তাকে গোসল করানো, খাওয়ানো, দেখভাল করা সবকিছু পরম যত্নে করতেন তিনি। কবি তখন এতোটাই শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দিতে হতো। সেবা ও স্নেহের দ্বারা অল্পদিনেই কবির কাছে প্রিয় মানুষ হয়ে উঠলেন উমা।
এরইমধ্যে উমার এমন মিষ্টি ব্যবহার দেখে এবং তার দায়িত্বশীল মনোভাব দেখে তার প্রেমে পড়ে গেলো কবিপুত্র সব্যসাচী কাজী। উমার কাছে নিজের ভালোবাসার আহ্বান জানানোর পর উমাও ‘না’ করতে পারেন নি। দু’জনের ভেতর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। বিয়েও করে ফেললেন তারা। বিয়ের পর উমা মুখার্জি হয়ে উঠলেন উমা কাজী। পুত্রবধুকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন প্রমীলা।
এতদিন তার দায়িত্বে ছিলো শুধু এক কবি, এখন থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্বই তার ওপর চলে গেলো। নিজের নতুন সংসার, কবির যত্ন, অসুস্থ প্রমীলার দেখাশোনা থেকে শুরু করে পুরো সংসারের সবকিছুই নিজের হাতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাতে শুরু করলেন উমা।
১৯৬২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন প্রমীলা কাজী। পুরো সংসারে নেমে এলো শোকের ছায়া। এই সংসারের সবকিছু একা হাতে সামলে নেওয়া শুরু করলেন উমা কাজী।
সব্যসাচী-উমার ঘরে একে একে এলো তিন সন্তান। মিষ্টি কাজী, খিলখিল কাজী আর বাবুল কাজী। নাতি-নাতনির খেলার সাথী নজরুল। নজরুলও তো মনেপ্রাণে তখন শিশুর মতোই। নিজের সন্তানদের যেভাবে যত্ন করতেন উমা, তেমনি নজরুলকেও রাখতেন পরিপূর্ণ যত্নআত্তির ভেতর। কারণ উমা ছাড়া অন্যকেউ কবিকে সেভাবে বুঝতে পারতো না। পুত্রবধু হয়েও উমা যেন বাস্তবে হয়ে উঠলেন কবির মা। একদম মায়ের মত করেই তাকে আগলে রাখতেন।
১৯৭২ সালে কবিকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলো। সব্যসাচী ব্যবসায়িক কাজে তখন বাংলাদেশে না আসতে পারলেও কবির সাথে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসলেন পুত্রবধু উমা। এরপর তাদের ঠিকানা হলো ধানমন্ডি।
বৌমা চন্দন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে না দিলে গোসল করেন না নজরুল, দাড়ি কেটে দেয় বৌমা-ই, গল্প করে করে খাইয়ে দিতে হবে বৌমাকেই, অন্যকেউ হলে চলবে না। বৌমার কাছে শিশুর মতো আবদার-বায়না করতেন কবি।
এভাবেই বৌমা থেকে কবির স্বয়ং ‘মা’ হয়ে গিয়েছিলেন উমা কাজী। কবির জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মায়ের মতোই সেবা করে গেছেন নির্বাক অসুস্থ কবির।
১৯৭৬ সালে সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন দুই বাংলার তুমুল জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। উমা যেন তার শ্বশুরকে নয়, হারালেন তার সন্তানকে, নার্সের সেবা করতে এসে যেই সন্তানের দায়িত্ব তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, আমৃত্য নিষ্ঠার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করলেন তিনি। কোনদিনই একচুল হেরফের হয়নি।
উমা কাজী বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশেই। ২০২০ সালে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা উমা কাজী। বনানীতে দাফন করা হয় তাকে।
নজরুল আমাদের সবার কাছেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার এবং চিরস্মরণীয়। তবে নজরুলের পাশাপাশি নজরুলের জীবনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তাদের কথাও আমরা যেন ভুলে না যাই। উমা কাজী নজরুলকে যেভাবে আমৃত্য সেবা করে গেছেন, এমন নজির খুব একটা চোখে পড়ে না আর।
কবিকে স্মরণ করে উদযাপন করা বিশেষ কোন দিবসে তাই কবির পাশাপাশি উমা কাজীর নামটাও আমার স্মরণে আসে। তার প্রতিও মনের ভেতর থেকে গভীর একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে।
পুত্রবধু থেকে পুরোদস্তুর এমন ‘মা’ হয়ে উঠেছেন কেউ, এমন নজির সম্ভবত পুরো পৃথিবীতেই বিরল একটা ঘটনা। এমন এক মায়ের কথা পুরো পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই।