■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই মাসে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। তবে মাত্র তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীঘিনালার ঘটনার পর গত ১ অক্টোবর পাহাড়ে আরও একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর জের ধরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে চার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিহত হন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বের দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে মারা হয় দুজনকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে চোর অপবাদে দিয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ শামীম মোল্লাকে।
এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় পঙ্গু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে। এদিকে চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নাচ-গান করে শাহাদাত হোসেন নামের একজন যুবককে পিটিয়ে হত্যার এক মাস পর সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আসক বলছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরের ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৮১ জনকে গণপিটুনিতে বা পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ এর মধ্যে আগস্টে ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে, আর ২৮ জনকে সেপ্টেম্বরে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই দুই মাসে ৪৯ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগের সাত মাসে এমন ঘটনা অনেক কম। ওই সাত মাসে মাত্র ৩১ জনের মৃত্যু হয় গণপিটুনিতে।
গণপিটুনির বাইরে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতে।
তবে নবনিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের দাবি, ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যার ঘটনা ঘটেনি।
হত্যা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রের যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার, সেটা হয়নি। স্থিতিশীলতা আসেনি। এখন যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন, তাঁদের কঠিনভাবে দক্ষতার সঙ্গে যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, তাঁরা সেটা নেননি। হয়তো তাঁদের সেই দক্ষতা নাই। এরপর পুলিশ বাহিনীকে ডিমরালাইজ করা হয়েছে। তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখিনি। ফলে মব জাস্টিস উৎসাহিত হচ্ছে। যদি কাঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে এগুলো ঘটত না।’
তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগেও একই ঘটনা সেখানে ঘটেছে। ফলে ওই এলাকায় এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর হাত থাকতে পারে। কিন্তু সরকারকে তো সেটা বের করতে হবে। আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি অব্যাহত আছে। ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।’
তবে ‘মব জাস্টিস’ বন্ধ করতে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি মহোদয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলেছেন। দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে। পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনির ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দুজন এবং চট্টগ্রামে নাচ-গান করে একজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ঘটনায় আমাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আর এখন তো অধিকাংশ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়। তাই, আশা করি বাকিদের গ্রেফতার সহজ হবে।’