:: ফারহান আরিফ ::
অপেক্ষমান ঊষ্ণ জলরাশি অনুমতি প্রার্থনা করলো, “আমি আসতে চাই।”
চিনচিনে যন্ত্রণাটাকে চাপা দিয়ে উত্তর আসলো একটা মাত্র শব্দে, “না।”
মনের খুব গভীরে বিউগলের সুরের মত বেজে যাচ্ছিলো জেমসের বিখ্যাত গান- কান্নায় লাভ নেই; কান্নায় হবেনা; কোনদিন পদ্মা, মেঘনা…।
একটা তেতো অভিমান অনুচ্চারিত আওয়াজে মিলিয়ে গেলো। তিল তিল করে গড়ে ওঠা বৃহৎ ভালবাসার অমন পঙ্কিল প্রতিদান পেয়ে অশ্রুমালাও যেন অপমান বোধ করলো। প্রচন্ড শব্দের বিপরীত যেমন হীন, নগণ্য; এই ভালবাসার তেমনি ঘৃণারূপ অনুভূত হল।
ঊষ্ণ জলরাশি আবারো ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো।
: পারছিনা আমি!
: পারতে এবার হবেই।
: এভাবেও সম্ভব?
: এটাই শেষ কথা। আর অশ্রুপাত নয়।
: কিন্তু এতোদিনের শ্রম, ঘাম, ত্যাগের এই প্রতিদান!
: শোন, ভীরু মন! “আপনারে যতন করো!”
: আমি তো ভালবেসেছি!
: মিথ্যে, সব মিথ্যে। মিথ্যাকে ভালবাসা অর্থহীন।
একটা শ্লেষমাখা আর অভিসম্পাত দেওয়ার সুরেই যেন শেষের কথাগুলো বেরিয়ে আসলো। স্মৃতীজুড়ে পুরনো দিনগুলির আনাগোনা শুরু হল। সেই যে কাকডাকা ভোর! বাসার গলিতে র্যাবের টহল গাড়ি। দোয়া ইউনুছ পড়তে পড়তে গলি পার হয়ে মেইন রাস্তায় নিরীহ ভঙ্গীতে, ভাবলেশহীন যাত্রা! কখনো শাহবাগ, কখনো বুয়েট এলাকা, পলাশী, চানখারপুল, আজিমপুর, নীলক্ষেত। আবার কখনো মৎস্য ভবন এলাকা, কিংবা হাতিরপুল। মাঝে মাঝে তো মতিঝিল, আরামবাগ, এমনকি ধানমন্ডির রাস্তাজুড়েও স্লোগানে স্লোগানে বিদ্রোহের গান গাইতে হয়েছে। এক পাহাড় আতঙ্ক নিয়ে সেইসব দিনগুলিতে ভালবাসার আগুনে উচ্ছ্বাস জড়িয়ে ধরেছে এ শহরের পিচঢালা পথকে।
দৃষ্টিজোড়া আকাশে নিবদ্ধ। এভাবে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে মুখ আকাশের দিকে করে তাকানো হয়েছে কিনা মনে পড়ছে না। আকাশজুড়ে ছোটবড় অজস্র তারা মিটমিট করে জ্বলছে। কিছুক্ষণ দেখলে মনে হয় আকাশটা অজস্র টর্চ জ্বেলে নিচে নেমে আসছে। এই অজস্র তারার মেলাকে নির্ভরতার প্রতীক বলে মনে হচ্ছিলো। একটা উপলব্ধির সুর বেজে উঠলো, আমাদের মাথার উপর কত তারা! অথচ আমরা কখনো লক্ষ্যই করি না! তারায় তারায় সমুজ্জ্বল নির্মোহ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীলিমার চেহারাটা ভেসে উঠলো। নেত্রীকে যেদিন জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হল, তার আগের দিন বিকেলে। দেশজুড়ে একটা থমথমে অবস্থা। বেশ একটা উদ্বেগ, উৎকন্ঠার মাঝে দিয়ে যাচ্ছিলো অলস বিকেলটা। ফোনটা রিসিভ করতে ইচ্ছে করছিলো না। কয়েকবার রিং বাজার পর ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত কন্ঠ, “কোথায় তুমি?”
: বাসায়।
: নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
: চা-আড্ডায় গিয়ে বসো। আসছি।
নীলিমার এমন হঠাৎ আগমন সেবারই প্রথম নয়। এর আগেও বহুবার এমন হুট করেই চলে এসেছে। এমনকি কোন কারণ ছাড়াই!
চা-ড্ডার একেবারে দক্ষিণ কোণায় মুখোমুখি দু’টা চেয়ার। তারই একটিতে বসা নীলিমা। দূর থেকে খেয়াল করলে ওর চেহারায় যে স্নিগ্ধতা, সারল্যতার ছাপ দেখা মেলে, কোন প্রেমিক মনকে তা তাড়িত না করে পারে না। মুখোমুখি চেয়ারটাতে বসতে না বসতেই এক পাহাড় সমান উৎকন্ঠা ভরা চেহারায় নীলিমার জিজ্ঞাসা, “কেমন আছো?”
: ভালো। তুমি?
উত্তর এলো না। খানিকটা নীরবতা। নীলিমা এবার বলতে শুরু করলো, “আমি কেন এসেছি তুমি বুঝতে পারছো?”
: হ্যাঁ।
: দেখো, আমি জানি এই সিদ্ধান্তটা নেয়া তোমার জন্য অনেক কঠিন। তোমার চলার পথে কখনোই কোন মন্তব্য করিনি। হয়তো আজোও নিশ্চুপই থাকতাম। কিন্তু আমি সত্যিই হেল্পলেস। কেন, সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবে জেনে রাখো, কাল যদি তুমি রাস্তায় বের হবার সিদ্ধান্তটা থেকে সরে না আসো তবে আমি সত্যিই আর যোগাযোগ রাখতে পারবো না।
একটা মুখোমুখি নীরবতা। দু’তিন মিনিট কেটে গেল এভাবেই। একটা অসহায় দৃষ্টি পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে লক্ষ্যহীন। নীলিমার চোখ থেকে কপোলে নেমে এসেছে অসহায় অশ্রুধারা। চায়ের কাপ দু’টো একইরকম পড়ে আছে। এরকম হয়েছে কি কখনো? দু’জন মানুষ দু’টি পূর্ণ চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে; কিন্তু কারো কোন আগ্রহ নেই!
নিজেকে সামলে নিয়ে নি:শব্দে উঠে পড়লো নীলিমা। চাপা কন্ঠে আরেকবার বলে গেলো, “আমি সত্যিই হেল্পলেস। আমাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।”
মাগরেবের আজান হয়ে গেছে। নামাজটা ঠিকঠাক পড়া হয়না এখন। তবে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। অশান্ত, বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে “আল্লাহু আকবার” বলতেই দু’চোখ থেকে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত নোনা জলের প্লাবন শুরু হল।
ক্লান্ত মনটা পাথরের মত স্থির হয়ে আছে। আবারো ফোনটা বেজে উঠলো। আম্মুর ফোন, “আগামীকাল না বেরুলে হয় না?”
একটা নৈ:শব্দ।
“সাবধানে থেকো।” ওপাশ থেকেই লাইনটা কেটে গেলো।
আগামী সকালে কি হতে পারে সে উত্তেজনায় দু’চোখকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিলো না। আবার মিছেমিছি মেলাতে গেলে আবছায়া হয়ে ভেসে উঠছে নীলিমার মুখ। আর সন্ধ্যা থেকেই মস্তিস্ক জুড়ে অনুরণিত হচ্ছিলো ফোনের ওপাশ থেকে ধ্বনিত হওয়া আম্মুর কন্ঠস্বর। একটা যন্ত্রণাদায়ক যুদ্ধের মাঝেই মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসলো ফজরের আজানধ্বনি। নামাজ শেষে একজোড়া নিদ্রাহীনতার কবলে পড়া রক্তবর্ণ চোখ বাইরের আকাশটায় স্থীর হল। আজকের আকাশ অন্যরকম!
চারদিকে একটা গুমোট ভাব। ফার্মগেট ওভারব্রিজের ওপরে উঠতেই আতঙ্কটা অনুভূত হল। চারিদিকে লাঠিসোঁটা হাতে অপোজিশনের মহড়া। ডিবি, পুলিশের সতর্ক চোখ। নিজেকে বেশ অসহায় মনে হচ্ছিলো। এই বুঝি কেউ এসে চার্জ করে! “আই এম স্যরি” মুঠোফোন থেকে নীলিমার নম্বরে একটা ক্ষুদেবার্তা চলে গেল কেমন নির্লিপ্ত ভঙ্গীমায়!
তারাগুলো যেন আরো কাছাকাছি এসে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। পুরো আকাশটাই কি মাথার উপরে এসে ঠেকেছে! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতীর খেরোখাতা খুলে গেল অকপট। পাঁচ বছরের ক্যাম্পাস লাইফ; এরপরের আরো এতগুলো বছর! যে স্বপ্ন নিয়ে প্রথম এই সবুজ গালিচায় পা মাড়ানো, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে? প্রশ্নটা ছোট; উত্তরটাও ছোট। কিন্তু এমন জটিলতার আবর্তে ঘেরা সংক্ষিপ্ত উত্তরটাকে আর মনে করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না।
অপেক্ষমান ঊষ্ণ জলরাশি আরো একবার অনুমতি প্রার্থনা করলো, “আসবো?”
আর দৃঢ়তা নেই। নোনা জল বেরিয়ে আসলো কোটর খুলে। কপোলের জমিনে স্থির হয়ে থাকা একফোঁটা ঊষ্ণ জল নীরিহের মত গোঙাচ্ছিলো, “কিছুই হলো না আমার!”
এক ফোঁটা ঊষ্ণ জল! অথচ কত ভারী। আকাশটা সরে যাচ্ছে। নিশ্চল মূর্তির মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
ভালো লাগলো।