চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার ইতিহাস

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের জব্বারের বলী খেলার এবারের ১১৬তম আসরেও শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছেন কুমিল্লার বলী বাঘা শরীফ। শ্বাসরুদ্ধকর পেশি শক্তির লড়াইয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এবারও চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। গতবারের মতো এবারও তার কাছে পরাজিত হয়েছেন একই জেলার আরেক তরুণ বলী মো. রাশেদ।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে তাদের দুজনের মধ্যে চলে শ্বাসরুদ্ধকর পেশি শক্তির লড়াই। গতবছরের জব্বারের বলী খেলায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তরুণ বলী বাঘা শরীফ।

বলী খেলার শুরু থেকেই লালদীঘির মাঠের চারপাশ মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যেও আকর্ষণীয় বলী খেলা দেখা থেকে পিছপা হননি শিশু থেকে বয়স্ক কেউই। চারপাশের হাজারো দর্শকের মুহুর্মুহু করতালি, ঢোল ও বাশির শব্দের তালে তালে কিছুক্ষণ পর পর বলীরা উঠতে থাকেন মঞ্চে। এবারের জব্বারের বলী খেলায় অংশ নিয়েছেন ১২০ জন বলী। যাদের বেশিরভাগই তরুণ ও যুবক। বেশ কয়েকজন ছিলেন বয়স্কও। বিকেল চারটা থেকে শুরু হয় বিশেষ আকর্ষণের বলী খেলা। প্রথম রাউন্ডে ৮০ জন বলী অংশ নেন। পরে প্রথম রাউন্ডের চারজন ও আগের বছরের শীর্ষ চারজন নিয়ে হয় চ্যালেঞ্জ রাউন্ড।

ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯০৯ সালে স্থানীয় আব্দুল জব্বার সওদাগর লালদিঘী মাঠে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামবাসীসহ সারাদেশের মানুষের কাছে এটি আব্দুল জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামি-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছর ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় এই বলী খেলা। ঐতিহ্যবাহী এই খেলাকে ঘিরে খেলার আগের দিন ও পরের দিন পর্যন্ত চলে তিন দিনের বৈশাখী মেলা।

আজিজ আনুষ্ঠানিকভাবে বেলুন উড়িয়ে বলীখেলার উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী আয়োজনে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। খেলায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

শওকত আনোয়ার বাদল জানান, এবারের বলীখেলায় সবচেয়ে বয়স্ক বলী ছিলেন কলিম উল্লাহ (৬৬)। আবার সবচেয়ে কম বয়সের বলী ছিল কিশোর ফয়সাল (১৬)। সবশেষে ফাইনাল রাউন্ডে বাঘা শরীফ ২৩ মিনিটে রাশেদ বলীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এর আগেরবার ১১৫তম আসরে ১১ মিনিট লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বাঘা শরীফ।

শতবর্ষী এই বলী খেলায় ১১৪তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কুমিল্লার মাংস বিক্রেতা শাহজালাল বলী। আর রানার্সআপ হয়েছিলেন চকরিয়ার তারিকুল ইসলাম (জীবন) বলী। এর আগে ২০২২ সালে শাহজালালকে পরাজিত করে  চ্যাম্পিয়ন হন তারিকুল ইসলাম। 

আর ২০১৯ সালে তারিকুলকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেছিলেন শাহজালাল বলী। তারও আগের বছর ২০১৮ সালে শাহজালালকে হারিয়ে প্রথম শিরোপা জিতেছিলেন তারিকুল। কয়েক বছর ধরে এভাবে দু‘জনের মধ্যে শিরোপার লড়াই চলতে থাকে।

তবে জব্বারের বলী খেলায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কক্সবাজারের রামুর দিদারুল আলম দিদার বলী। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি সর্বোচ্চ ১১ বার বিজয়ী হয়েছেন। এরপর থেকে দিদার বলী এ খেলা থেকে অবসরে আছেন। ১৯ বছর বয়সে জব্বারের খেলায় অংশ নিয়ে ৩৩ বছর বয়সে অবসরে যান এই বলী।

বলীখেলা ঘিরে বৈশাখি মেলা প্রতিবছর বাংলা ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলীখেলা। বলী খেলাকে ঘিরে তিন দিনব্যাপী বৈশাখি মেলা বসে লালদীঘির আশপাশের এলাকায়। এবার ২৪ এপ্রিল বৃহৎ¯প্রতিবার থেকে লালদীঘির মাঠ ও আশপাশের এলাকায় শুরু হয় বৈশাখি মেলা। 

আবদুল জব্বারের বলীখেলা উদ্‌যাপন কমিটির ১১৬তম আসরের আহবায়ক হাফিজুর রহমান জানান, ১৯০৯ সালে বকশিরহাটের বিশিষ্ট বণিক ও চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতির বাসিন্দা আবদুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে এই বলীখেলার প্রচলন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা ‘জব্বারের বলীখেলা’ নামে পরিচিতি পায়। সেই থেকে নিয়মিত বলীখেলার আসর বসলেও মাঝখানে দুই বছর (২০২০ এবং ২০২১) করোনার জন্য এবং তারও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়নি।

মূলত সুলতানি আমল থেকে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে কুস্তির চর্চা হতো চট্টগ্রামে। তখন এ অঞ্চলের সেনারা ছিলেন মূলত পদাতিক। তাই কুস্তির মধ্য দিয়ে শারীরিক সামর্থ্য ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের। এরপর মল্ল সম্প্রদায়ের মানুষজন গ্রামে গ্রামে বৈশাখ মাসে বলী খেলার আয়োজন করতেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশ বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁদের কর্মকান্ডের উপরে ব্রিটিশদের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। তাই বিকল্প পন্থা হিসাবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা ও তাঁদের সমর্থকরা।

আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করলেও, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকে স্বনামধন্য বলীরা এ খেলায় অংশগ্রহণ করতেন। এ প্রসঙ্গে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন, “চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলী খেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলী খেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।”

প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে আঘাত না করে কিংবা তাকে আহত না করে পুরোপুরি ধরাশায়ী করাই বলী খেলার লড়াইয়ের নিয়ম। তাই এ খেলায় কেবল শারীরিক সামর্থ্যেরই পরীক্ষা হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মালেক ৩০ বছর ধরে বলী খেলার রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বলীর লড়াইয়ের নিয়মকানুন সম্পর্কে জানা গেল তাঁর কাছ থেকে।

তিনি বলেন, এখানে কোনো পয়েন্টের নিয়ম নেই। কুস্তি করতে করতে মাটিতে যার পিঠ যে ঠেসে ধরতে পারবে সে-ই বিজয়ী হবে। সারা দেশের ১০০ জনের বেশি বলী অংশ নেন লড়াইয়ে। শুরুর দিকে চলে বাছাইপর্ব। লটারির মাধ্যমে বলীরা একজন আরেকজনের সাথে লড়াইয়ে অংশ নেন। সেখান থেকে বাছাই করা হয় আটজন বলীকে। তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় কোয়ার্টার ফাইনালের চারটি, সেমিফাইনালের দুটি ও ফাইনালের একটি খেলা। মাগরিবের নামাজের আগেই শেষ হয়ে যায় জমজমাট এই খেলার আসর।

জব্বারের বলী খেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি জওহরলাল হাজারী বলেন, “চট্টগ্রামের বলী খেলাকে আরো প্রসারের চিন্তা করা হচ্ছে। সে রকম সরকারি আশ্বাস রয়েছে। শহরের স্টেডিয়ামের পাশে প্রশিক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রে স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

চট্টগ্রামের অন্তত ২২টি মল্ল পরিবারের নাম ইতিহাসে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন— আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল,মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল ও গৈরলার চুয়ান মল্ল।

চট্টগ্রামের বলী খেলাকে ঘিরে যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, তার অনুসন্ধানে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন, “এক সময় চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি বড় গ্রামেই ২ থেকে ৪টি করে বলী খেলার আয়োজন হতো। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কাল থেকে এই ঐতিহ্যে ছন্দপতন ঘটতে থাকে; বলী খেলার সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পায়।” তিনি আরও জানান, উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে বলী খেলার ছিল ব্যাপক খ্যাতি। বিশেষত: মহারাজ্যা বাপের বলী খেলা, ফতেপুরের বলী খেলা, হাটহাজারীর বলী খেলা, নদীমপুরের বলী খেলা, মাদার্শার বলী খেলা ও ফটিকছড়ি-রাউজান অঞ্চলের বলী খেলা।

এতে অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য বলিষ্ঠ ও খ্যাতনামা বলী, যাদের নাম আজও কিংবদন্তির মতো উচ্চারিত হয়: লাল মিয়া বলী, দুইধ্যা বলী, এয়াকুব আলী বলী, সুলতান বলী, ওয়ালী বলী, জাফর আলী বলী, আছু বলী ও টুইখ্যা বলী। মধ্য চট্টগ্রামের বলী খেলাগুলোও ছিল সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: পটিয়ার বলী খেলা ও তুফান আলী মুন্সীর বলী খেলা। এই অঞ্চলের বলীদের মধ্যেও বহু নাম অমর হয়ে আছে ক্রীড়া-ইতিহাসে: গইন্যা বলী, মিরা বলী, আসাদ আলী বলী, আহমদ ছফা বলী ও কুমীরে খাওয়া বলী।

‘বলী খেলা’ শব্দটি অনেক সময়ই ‘কুস্তি খেলা’র সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, বাস্তবে রয়েছে সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যময় ভিন্নতা। বলী খেলা শুধু দেহশক্তির প্রদর্শন নয়, এটি চট্টগ্রামের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার তার ‘বাংলাদেশের খেলাধুলা’ বইয়ে এটিকে সরলীকরণ করে ‘কুস্তি’ বলেননি। তিনি লিখেছেন, “জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়।”

চট্টগ্রামে বলী খেলার সূচনা নিয়ে দুটি পৃথক তত্ত্ব পেশ করা হয়েছে। কবি আলাদিন আলীনুরের বর্ণিত ঐতিহাসিক বিবরণটি আকর্ষণীয়, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, প্রতি বছর চৈত্রের শেষার্ধ ও বৈশাখের প্রথমার্ধে বলী খেলার মৌসুম শুরু হতো। এই সময়ে বসত মেলা, নতুন পণ্যের আমদানি ও ব্যাপক বেচাকেনা হত, আর চারদিকে শোনা যেত বাদ্যধ্বনি ও সানাইয়ের আওয়াজ। আলীনুর দাবি করেন, “১৩৪৫-৪৬ সালে ইবনে বতুতার পরিদর্শনের সময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বরহনক থেকে বলীরা খেলায় যোগ দিতে আসায় দর্শকদের উত্তেজনা বাড়ে। কবি কালিদাসের জন্মভূমি মালিয়ারা ও কবি আফজল আলীর জন্মভূমি মিলুয়া অঞ্চল থেকে বলী খেলার উদ্ভব হয় এবং তা চট্টগ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।”

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আলীনুরের বর্ণিত ইতিহাসের সাথে ভিন্নমত পেশ করেন। তিনি বলেন, “যদি মালিয়ারা ও মিলুয়া অঞ্চলকে মল্ল ক্রীড়ার জন্মস্থান হিসেবে ধরা হয়, তবে রাউজান থানার ডাবুয়া ইউনিয়নের মেলুয়া গ্রামেও বলী খেলার উদ্ভব ঘটতে পারে। তবে চট্টগ্রামের চতুর্দিকে বলী খেলার উৎপত্তি নিয়ে বিরোধের পরিবর্তে একত্রিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত।”

মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকেও বলীরা এ খেলায় অংশ নিতে আসতেন। এছাড়া সিলেট অঞ্চলেও বলী খেলার প্রচলন ছিল, যা ‘মাল খেলা’ নামে পরিচিত ছিল। এ বিষয়ে আবদুল হক চৌধুরী লিখেন, “সিলেটে মাল খেলা শরৎ ও হেমন্তকালে অনুষ্ঠিত হত।” তবে ‘মাল খেলা’ আসলে ছিল সিলেট অঞ্চলের শক্তি প্রদর্শনের খেলা, যার প্রকৃতি বলী খেলার কাছাকাছি। তবে এর পোশাক, নিয়মকানুন, আয়োজন ও প্রেক্ষাপট বলী খেলার চেয়ে ভিন্ন।

জব্বারের বলী খেলা ধারাবাহিকতার দিক থেকে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক খেলা হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে, যেমন চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, রাউজান, হাটহাজারী, চান্দগাঁও ও কক্সবাজারে আজও বলী খেলার আয়োজন হয়, যা এ খেলার জীবন্ত ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত। আজ বলী খেলা আজ বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি একদিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরম্পরার ধারক, অন্যদিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের ঐতিহাসিক আয়োজন।

আব্দুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল জানান, ৫০ বছর আগেও বলীরা খেলায় অংশ নিতে মাস দু’য়েক আগে চট্টগ্রামে এসে জড়ো হতেন। তাদের বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন। সেখানেই তারা খাওয়াদাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন। সত্তরের দশক থেকে সারা দেশের বলীরা জব্বারের বলী খেলায় আসছেন। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলেও জানান বাদল।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বলীদের সেই প্রতাপ ও তাঁদের সামর্থ্য কিছুটা মলিন হয়েছে। তবে এখনো শখের বসে শ-খানেক বলী সারাদেশ থেকে জব্বারের বলী খেলায় আসেন।

জব্বারের বলী খেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন, চকরিয়ার জীবন বলী বলেন, “আমরা গরীব মানুষ। ওভাবে খাওয়া-দাওয়া করা সম্ভব হয়না। তবে ফাল্গুন মাস থেকে আমরা নিজেরা নিজেরা প্রস্তুতি নেই।” কক্সবাজারের আরেক বলী বান্টু জানান, তাঁর পরিবার ঐতিহাসিকভাবে এই খেলার সঙ্গে জড়িত। দাদা-পরদাদা ও বাবা সবাই বলী ছিলেন। এবারের বলী খেলার জন্য গত তিনমাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে নিয়মিত দুধ-ডিম ও সবজি খেয়েছেন তিনবেলা।

এদিকে সাহাবুদ্দিনের বলী খেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বাদশা বলী বলেন, “মাসখানেক ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। এখানে আমরা যারা এসেছি তারা খেলার মঞ্চে প্রতিপক্ষ হলেও এর বাইরে সবাই ভাই-ভাই। তাই সকলে মিলেমিশে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের কোনো ব্যয়ামাগার নেই। এমন কিছু থাকলে ভালো হতো।”

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *