■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসার সময় এক চাকা (বাম পাশের ল্যান্ডিং গিয়ার) খুলে পড়া বিমানের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি ঢাকায় জরুরি অবতরণ করেছে। ফ্লাইটটি পরিচালনা করছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহ।
এর আগে শুক্রবার (১৬ মে) দুপুর ১টা ২০ মিনিটে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে বিজি ৪৩৬ (ড্যাশ ৮-৪০০) ফ্লাইটটি। বিমানটিতে এক শিশুসহ মোট ৭১ জন যাত্রী ছিল।
উড্ডয়নের পরপরই পাইলট ঢাকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে (এটিসি) জানান, তিনি জরুরি অবতরণ করতে চাচ্ছেন। পাইলটের বার্তা পাওয়ার পরপরই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জরুরি অবতরণের প্রস্তুতি নেয়। প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিস।
পাইলট প্রথম চেষ্টাতেই দুপুর ২টা ২২ মিনিটে ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণে সক্ষম হয়েছেন। যাত্রীরা সবাই নিরাপদ ও অক্ষত আছেন। সবাইকে প্লেন থেকে নামানো হয়েছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এক বার্তায় জানায়, আজ দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা বিমানের ফ্লাইট বিজি-৪৩৬, যাতে ৭১ জন যাত্রী ছিলেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসার পথে বাম পাশের ল্যান্ডিং গিয়ার চাকার সমস্যার পরিলক্ষিত হলে বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানানো হয়। তাৎক্ষণিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পরে ফ্লাইটটি দুপুর ২টা ২২ মিনিটে ঢাকায় নিরাপদে অবতরণ করে। যাত্রী এবং ক্র সবাই সুস্থ ও নিরাপদ রয়েছেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্যান্য বিমান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে বলেও বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
এ ঘটনায় বিমানের চিফ অব সেইফটি ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ও বিমানের প্রকৌশল শাখা থেকে আরও একটি কমিটি গঠন করা হবে।
বিমানবন্দরের পাশে শুক্রবার দুপুর ২টা ১৯ মিনিটে যখন বিমানটিকে দেখা যায় তখন পাইলটের সঙ্গে অবতরণের বিষয়ে যোগাযোগ করছিল ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) রুম।
ফ্লাইটটিকে দেখামাত্র এটিসি থেকে পাইলটকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কী এই অবস্থায় রানওয়ে ১৪ দিয়ে অবতরণের বিষয়টি কনফার্ম করছেন?
পাইলট জামিল বলেন, ‘অ্যাফার্ম (হ্যাঁ নিশ্চিত করছি)।’
পাইলটের কনফার্মেশন পাওয়ার পর এটিসি থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পাইলটকে জানানো হয়, ‘রানওয়ে ১৪ অবতরণের জন্য প্রস্তুত আছে। আপনি অবতরণ করতে পারেন।’
এটিসির সর্বশেষ বার্তা পাওয়ার ৯০ সেকেন্ড পর দুপুর ২টা ২২ মিনিটে বিমানের ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণ করে।
একদিকে যখন পাইলট এবং এটিসির কথোপকথন চলছিল রানওয়ের চারপাশে অবস্থান নিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট।
বিমানের ফ্লাইটটি পুরোপুরি থামার পর এটিসিকে পাইলট বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ আমরা নিরাপদে অবতরণ করেছি। কন্ট্রোল টাওয়ারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের সহযোগিতা ছিল প্রশংসনীয়।’
টাওয়ার থেকে বলা হয়, আপনি কী কনফার্ম করছেন আপনি নিরাপদে অবতরণ করেছেন?
পাইলট জানান, ‘হ্যাঁ, আমি আবারও নিশ্চিত করছি।’
টাওয়ার থেকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি কী কনফার্ম করছেন সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক রয়েছে?’
পাইলট বলেন, ‘এভ্রিথিং ইজ অ্যাবসোলুটলি ফাইন (সবকিছু ঠিক আছে)।’
টাওয়ার বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ধন্যবাদ আপনাকে।’
পাইলট বলেন, ‘আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের এটিসিকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন।’
এটিসি থেকে পাইলটকে বলা হয়, ‘আপনার বার্তাটি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনি ট্যাক্সিওয়েতে অবস্থান করুন।’
ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণের পর রানওয়ের চারপাশে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অধিকাংশই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে তালি দিতে থাকেন।
সেসময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এবিএম রওশন কবীর জানান, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে আকাশে ওড়ার পরই পেছনের একটি চাকা খুলে নিচে পড়ে যায়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং টিম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশে অবস্থান করছে। ফ্লাইটটি ইমারজেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিমানের বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছে, পেছনের এক চাকাতেও বিমান জরুরি অবতরণ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা উড়োজাহাজের জন্য জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে উড়োজাহাজ নিরাপদে নামাতে পাইলটের দক্ষতা ও উপস্থিত বুদ্ধির ওপরই নির্ভর করে অনেক কিছু। অনেক সময় এক পাশের চাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অবতরণ করতে গেলে উড়োজাহাজ কাত হয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়তে পারে। তাই পাইলটকে নির্ধারিত গতিতে, সুনির্দিষ্ট কোণে উড়োজাহাজকে রানওয়েতে নামাতে হয়, যাতে ভারসাম্য হারিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। তাই এ ধরনের জরুরি অবতরণের ক্ষেত্রে রানওয়েতে জরুরি সেবাদানকারী দল প্রস্তুত থাকে।
এ জন্য পাইলট শুরুতেই কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানিয়ে দেন। তখন বিমানবন্দরের ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে চলে আসে। পাইলট যাত্রীদের উদ্দেশে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও আশ্বাস দিয়ে মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করেন। অবতরণ শেষে যাত্রীদের নিরাপদে দ্রুত নামিয়ে আনা হয়।
উল্লিখিত উড়োজাহাজ চালনায় যুক্ত ছিলেন ক্যাপ্টেন বিল্লাহ ও ফার্স্ট অফিসার জায়েদ। বিমানের ফেসবুক পেজে তাঁদের ব্যাপক প্রশংসা করে একটি পোস্ট করা হয়েছে।
তবে ওই পোস্টের নিচে কেউ কেউ লিখেছেন, এটা যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, কর্তৃপক্ষের অবহেলা। তবে বিমান–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রকৌশল শাখার গাফিলতির একটা ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে।
বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েক মাস আগে বিমানের প্রকৌশলীদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের সুযোগ–সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে। যেখানে তাঁদের আরও দক্ষতার সঙ্গে বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। উল্টো তাঁদের ব্যর্থতার কারণে আকাশ থেকে বিমানের চাকা খুলে পড়েছে। এ ঘটনা বিমানের ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এই কর্মকর্তা।