:: শাহরিয়ার শিমূল ::
আম্মু আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক। এটা শুধু পারিবারিক পর্যায়ের শিক্ষক না, আক্ষরিক অর্থেই শিক্ষক। আমার প্রাথমিক পর্যায়ের চারজন শিক্ষকের দুজনই ছিলেন আমার আম্মু আর বড় মামী। পড়াশোনাকেন্দ্রিক আমার কাছে তাঁদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পাওয়ার পর তাঁদের আনন্দের মাত্রাটা আমার এখনও মনে আছে। আম্মু ভাবতেন, আমার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব। শেষবার যখন কুইজ প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থানের ক্রেস্টটা আম্মুর হাতে দিলাম, আম্মু বলতেছিলেন, চাইলে তুই কতো কিছুই না করতে পারতি! কিন্তু আমি আসলে কিছুই পারিনি। মায়ের জন্য কিছু করা তো অনেক দূরের বিষয়, একজন সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হবার মতো কিছুও আম্মু দেখে যেতে পারেননাই।
তবে আমাকে নিয়ে তাঁর প্রত্যাশাগুলো পূর্ণ না হলেও অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছিল। উনি কখনোই শুধু নিজের সন্তানকে একা একটা ভাল জায়গায় দেখতে চাননাই, বরং আমার চাচাতো ভাইবোনেরাসহ আশপাশের সব ছেলেমেয়েদেরই উনি ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইতেন। আমার চাচা-চাচীরা কিংবা প্রতিবেশীরা তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনার দায়দায়িত্ব নিশ্চিন্তে আম্মুর হাতে তুলে দিতে পারতেন। আমার চাচাতো ভাইবোনেরা সন্ধ্যা হলেই আমাদের বাসায় পড়তে চলে আসতো, আবার খাবারের সময়ে বাসায় যেতো। সব ছেলেমেয়েদের নিয়মানুবর্তিতার মাঝে রাখতেও আম্মু সবসময় সচেষ্ট থাকতেন, বাবা-মায়ের কথায় দুষ্টামি বন্ধ না করলেও আম্মুর শাসনের ভয় দেখিয়ে অনেক বেপরোয়া বাচ্চাকাচ্চাকেও ঘুম পাড়ানো যেতো। তাঁদের অনেকেই আজ নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে খুব ভাল অবস্থানে আছেন। একবার গাছের চারা কেনার জন্য স্কুলে আম্মুর ড্রয়ার থেকে ৫ টাকা চুরি করেছিলাম। সেটা বুঝতে পেরে আম্মু চুরির স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ঘন্টাখানেক আমাকে মেরেছিলেন। এরপর আর জীবনে ওপথে পা বাড়াইনি। এভাবে আম্মু সবাইকে পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের সাথেসাথে নৈতিকতার জ্ঞানেও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করতেন।
যেই মহিলা ছোটবেলায় খেলার সময়টাতেও আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন, সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর আবার রাত জেগে পড়াশোনার দেখভাল করতেন, ছেলেদের শখ-আহ্লাদ পূরণেই যাঁর ছিল সমস্ত আত্মতৃপ্তি, তাঁর জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। তাঁর ক্যান্সার শনাক্ত হবার সাথেসাথে চিকিৎসকেরা এটাও আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে এটা সবচাইতে আগ্রাসী ধরণের ক্যান্সার, নিরাময়যোগ্য নয় এবং সময়ও খুব বেশি বাকি নেই। এরকম পরিস্থিতিতে আম্মুর জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমার জীবনের সবচাইতে কঠিন যে সিদ্ধান্তটা আমাকে নিতে হয়েছে, সেকারণে সন্তান হিসেবে নিশ্চিতভাবেই আমাকে সারাটা জীবন দগ্ধ হতে হবে। আমরা আম্মুকে ক্যান্সারের বিষয়ে না জানালেও শারীরিক অবস্থার কারণে আম্মু অনুমান করতেন, ওনার আর খুব বেশি সময় বাকি নেই। ওনার জীবনের শেষ ইচ্ছে ছিল উনি ছোট ছেলের বউ দেখে যাবেন। কিন্তু আমি আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করবো, নাকি আমার একযুগের লড়াইটা অব্যাহত রাখবো, এরকম ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি সংগঠনের নিয়মটাই মেনে নিয়েছিলাম। বিয়ে করে গোপন রাখবার মতন অসততা করাটাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দেশমাতৃকার তরে লড়াইয়ের জন্য আমাকে মায়ের শেষ ইচ্ছেটাকেই তাই উপেক্ষা করতে হয়েছে।
শেষদিকে আম্মু অনেক ভয় পেতেন। হাসপাতালে যখন খুব কষ্ট হতো, আমাকে পাশে বসিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতেন, আমার হাতটা নিয়ে মাথায় রাখতেন। সেই মানুষটাকেই নির্জনে, অন্ধকারে, একাকী মাটির ঘরে নিজ হাতে শুইয়ে দিয়ে আসলাম। আম্মু আর কোনদিন বলবেন না, আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করবি না? নয়াপল্টন কিংবা কোথাও কোন ঝামেলার কথায় শুনলেই উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করবেন না। দিনে বহুবার ফোন করে খাওয়াদাওয়ার খোঁজ নিবেন না। সন্তান বাইরে থাকলেও আর উদ্বিগ্ন হবেন না!
আপনার ছোট ছেলেটাকে ক্ষমা করিয়েন, আম্মু! মহান আল্লাহ আপনার যাবতীয় ভুলত্রুটি মার্জনা করে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।
।। দুই ।।
আজ থেকে ১৮ বছর আগের কথা। ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনার বিষয়ে যখন আমার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল, আমি মোটেও রাজি ছিলাম না। কিন্তু আম্মু কিছুটা জোর করেই আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় আসবো, সেদিন সকাল থেকেই আম্মু প্রচন্ড কাঁদছিলেন। বাড়ির সবার সাথে যখন বিদায় নিয়ে আসতে গেলাম, আম্মুর কান্না দেখে সবাই আম্মুকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আমি অবশ্য একদম বিদায়লগ্নের আগে পর্যন্ত অতোটা আবেগী ছিলাম না। কেন ছিলাম না, সেটা এখন আর মনে করতে পারিনা। হয়তো মাকে ছেড়ে আসার মতো একটা বিষয়কে অনুভব করার মতন বয়স তখনও হয়নি। অথবা সবাইকে বিদায় বলতে বলতে শেষে যে আম্মুকেও বিদায় বলতে হবে, এই বোধটা তখন মাথায় কাজ করছিল কিনা কে জানে! তবে একদম শেষমুহুর্তে মা-ছেলের বিচ্ছেদের মুহুর্তে সেখানে একটা হৃদয়স্পর্শী পরিবেশই তৈরি হয়েছিল। এটা আমার এখনও মনে আছে। আর মায়ের কাছ থেকে দূরত্বে থাকার জীবন কেমন হয়, এটাও ঢাকায় পা দেয়ার সাথেসাথেই টের পাওয়া শুরু করেছিলাম। তারপরেও আম্মু তো ছিলেন, কিছুটা দূরত্বে হলেও ছিলেন। ইচ্ছে হলেই যেকোন সময়ে আম্মুর কাছে ছুটে যেতে পারতাম।
কয়েক বছরের দূরত্ব শেষে আবার গত কয়েকটা বছর মা-ছেলে ঢাকায় একসাথেও ছিলাম। গত কয়েক বছর গ্রামের বাড়িতে যতগুলো ঈদ করেছি, সবগুলো ঈদ শেষে সবাই একসাথেই ঢাকায় ফিরেছি। কিন্তু আজকে একজনকে না নিয়েই ফিরে আসলাম। কয়েক মাস আগে শেষবার যখন চাঁদপুর থেকে লঞ্চে ঢাকায় ফিরেছিলাম, সাথে শুধু আম্মুই ছিলেন। আজকে লঞ্চে সবাই আছে, শুধু আম্মু নেই। আম্মুকে চিরজীবনের জন্য বাড়িতে রেখে আসলাম। ১৮ বছর আগের বিচ্ছেদটা ছিল সাময়িক, কিন্তু এই বিচ্ছেদ আজীবনের! আম্মুকে আর চাইলেও কোনদিন সাথে করে নিয়ে আসতে পারবোনা।
শেষবার লঞ্চে আসার সময়ে আম্মু আমার সাথে ছবি তুলতে চেয়েছিলেন। এই বিষয়টা আম্মুর সাথে ঠিক যায় না। শারীরিক অবস্থার কারণে আম্মু হয়তো অনুভব করতেন, এটাই শেষ লঞ্চযাত্রা হতে পারে! কিন্তু আমি বুঝিনি!
মহান আল্লাহ ওনার যাবতীয় ভুলত্রুটি মার্জনা করে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আর আমাদেরকে যেভাবে গড়ে তোলার জন্য ওনার সারাটা জীবন বিনিয়োগ করেছিলেন, আমাদেরকে সেরকম মানুষ হয়ে ওঠার তওফিক দান করুন।