:: মারুফ মল্লিক ::
নারায়নগঞ্জে জন্ম ও বড় হওয়াতে দাদার বাড়ী ময়মনসিংহে খুব বেশি যাওয়া হয় নাই। তবে বছরে এক আধবার যাওয়া হইতো। বিশেষ করে শীতে বার্ষিক পরীক্ষার পর। তখন শুধু দাদার বাড়ী না, নানাবাড়ীও ঘুরা হইতো। পাশাপাশি জেলা হওয়াতে এক সঙ্গে ঢু মারার সুবিধা ছিল।
দাদাবাড়ী যাত্রা উপলক্ষে শেষ রাতে উঠতে হইতো। নারায়নগঞ্জ বা ঢাকা থেকে ট্রেনে ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে গিয়ে নামতাম। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে গাঙ্গিনার পার, পাট গুদাম হয়ে ফেরিতে ব্রহ্মপুত্র পারি দিয়ে শম্ভুগঞ্জ থেকে হালুয়াঘাটগামি বাসে চড়তে হতো। বাস চালু করার জন্য জনা বিশেক লোক ধাক্কা দিত পিছন থেকে। চালু হওয়ার সেই বাস অত্যন্ত ধীর গতিতে সারা শরীর কাপিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে খাদা খন্দময় রাস্তা পাড়ি দিয়ে এক বিকালে নিয়ে যেত ফুলপুর উপজেলা বাজারে। সেখানে যাওয়ার পর বাস আর ছাড়ে না। শতাধিকবার এগিয়ে, পিছিয়ে যখন বাস ছাড়বে তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবতে বসেছে।
পড়ন্ত এক বিকালে সেই বাস পৌছে দিত ধারা বাজারে। বিকেলের ধরে আসা আলোতে সফেদ পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরা বড় চাচা বাজারের মাঝখানে চেয়ারে বসে থাকতেন। বাস থেকে নামতে দেখেই তিনি অবসম্ভব জোড়ালো গলায় কাউকে একটা ডাক দিতেন। যৌবনে তিনি যাত্রার নায়ক ছিলেন। যাত্রা মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করতেন বলে শোনা যায়। বিভিন্ন গ্রামে যাত্রার দল নিয়ে যাইতেন। পুঁথি পাঠের জন্য অত্র তল্লাটে বেশ নামডাক ছিল। তাই উনার কণ্ঠটা বেশ দরাজ ও উচু ছিল। আর শেষ বয়সে জামি বিক্রি করে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করে হারতেন।
বড় চাচার ডাক শুনে যিনি সবার আগে এগিয়ে আসতেন উনার নাম মেন্দির বাপ। আমরা আসলেই উনার নাম জানতাম না। উনার ছেলের নাম ছিল মেহেদি। কিন্তু সবাই ডাকতো মেন্দির বাপ বলে। উনিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত হাটতেন। মাঝে মধ্যে আমাদের কোলে, কান্ধেও নিতেন।
এরপর রিকশা বা গরুর গাড়িতে ধুরাইল বাজার পর্যন্ত যাত্রা। রিকশা সব সময় মিলত না। তবে বড় চাচা দুটো রিকশা বলে রাখতেন আগে থেকেই। পিছনের রিকশায় তিনি উঠতেন। সামনের রিকশায় শহর থেকে আসা অতিথিরা, মানে আমরা। ধুরাইল বাজারের পর ফুফুর বাড়ী। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও হালকা আপ্যায়িত হয়ে আবার যাত্রা শুরু।
কয়েক মাইল মেঠো পথে হেটে বা কারো কাঁধে চড়ে কংশ নদীর গোদারা পার হয়ে ময়মনসিংহ গীতিকায় উল্লেখিত উলুয়াকান্দা বা উল্লাকান্দা বাজারে আমরা যখন পৌঁছাতাম তখন রাত হয়ে যেত। বর্ষকাল কাল হলে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ও ব্যাঙের দল ডাকতে শুরু করছে। আর শীতকাল কুয়াশা পড়তে শুরু করতো। গ্রামে গেলে পাটের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগতো। আর বৃষ্টির পর আকাশ পরিস্কার থাকলে মেঘালয়ের পাহাড় দেখা যাইতো। এটাও আমার কাছে এক বিস্ময়ের বিষয় ছিল। প্রথম পাড়ার দেখা ওই গ্রামেই।
দাদাবাড়ী গিয়ে আমি প্রথম নৌকা বাইচ দেখি লাহোর বিলের মধ্যে। বর্ষাকালে গেছিলাম আম্মার সঙ্গে। বিলের পাশেই সব থেকে বড় ফুফুর বাড়ী। সেখানে গিয়া দেখি বিলের চারপাশে হাজার হাজার মানুষ। বিলের চারপাশে যেন মেলা বসছে। নানা ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে। মূলত মিষ্টি জাতীয়। পরে আরেক ফুফুর বাড়ী বেড়াইতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন বাড়ীতে বাইচের নৌকা বান্ধা আছে। আমার দাদার বাড়ী ছিল মূলত ভাটি এলাকায়। বর্ষাকালে চারদিকেই কমবেশি পানি থাকতো। ফলে নৌকা নির্ভর জীবন ছিল তাদের।
গ্রামে গিয়া আমি আরো একটা জিনিস দেখছিলাম। ষাড়ের লড়াই। ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলে হাড়ের নাড়াই। দ্রুত বলতে গিয়ে বলে হারেনারে। তো সবাই হারেনারে দেখতে যাইতাছে। হারেনারে কি? আমি ত আর বুঝি না। ভাই ভাতিজাদের সঙ্গে আমিও হারেনারে দেখতে গেলাম মাঠের মাঝ খানে। এটা বলা হয় বন্দ। বন্দে গিয়া দেখি বিশাল সব তাগড়া জোয়ান ষাঁড় গুতাগুতি করতাছে। আর লোকজন খানিক পরপর হৈ হৈ করছে।
আরেকটা জিনিস দেখছিলাম। ধান কাটার মৌসুমে বাড়ী বাড়ী রাত জেগে ধান পাহাড়া দেয়। এই উপলক্ষ্যে সারারাতই বাড়ির বাইরে বারান্দায় বা উঠানে পুঁথিপাঠ ও গানবাজনা চলতো হারিকেনের আলোতে। তবে এই গান উচ্চস্বরে হয় না। এক ধরনের মিহি সুরে গায়। যেন ভিতেরর বাড়ীতে শব্দ না পৌঁছে। বাড়ির লোকজনের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।
যেই গ্রামে আমি কখনোই লম্বা সময় থাকিনি। খুব বেশি যাইও নি। এমনকি ওই গ্রামের সঙ্গে আমার এখন তেমন যোগাযোগও নাই। এই মেসেঞ্জারে কথাবার্তা হয়। কিন্তু তারপর মাঝে মধ্যে যখন চোখ বন্ধ করি। হুটহাটই সেই কংসেরর ছবি ভেসে উঠে। যেটা আমি বালকবেলায় দেখেছি। সেই কংস যার তীর ঘেষে আমার দাদার বাড়ী। আমার বেড়ে উঠা শীতলক্ষ্যার পারে। এখন থাকি রাইনের তীরে। কিন্তু কংসের কথা, পাটের গন্ধ এখনো আমার মনে পড়ে কেন?
ড. মারুফ মল্লিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক।