■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
চলতি বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন অর্থনীতিবিদ—জোয়েল মোকির, ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট (Joel Mokyr, Philippe Aghion and Peter Howitt)। উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁরা এ পুরস্কার পেয়েছেন।
এই তিন অর্থনীতিবিদের মধ্যে অর্ধেক পুরস্কার পেয়েছেন জোয়েল মোকির। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্তগুলো শনাক্ত করার জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। ‘সৃজনশীল বিনাশ’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব দেওয়ার জন্য বাকি অর্ধেক পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট।
বিবৃতিতে নোবেল কমিটি বলেছে, সব সময় প্রবৃদ্ধি হবে, এটা কখনোই নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় না। মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রবৃদ্ধি নয়, বরং স্থবিরতাই ছিল স্বাভাবিক অবস্থা। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সম্ভাব্য হুমকিগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবিলা করতে হবে।
ঐতিহাসিক উপাত্ত ও দলিল ব্যবহার করে মোকির দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উদ্ভাবন একসময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করেছে। অন্যদিকে আগিয়োঁ ও হাউইট সেই প্রবৃদ্ধির অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। ১৯৯২ সালের এক প্রবন্ধে তাঁরা গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন, যখন নতুন ও উন্নত কোনো পণ্য বাজারে আসে, তখন পুরোনো পণ্য বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে টিকে থাকতে পারে না। এই প্রক্রিয়াই অর্থনীতিতে ‘সৃজনশীল বিনাশ’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ পুরোনো ব্যবস্থার ভেতর থেকেই নতুন উদ্ভাবন হয়।
পুরস্কারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে, গত দুই শতকের ইতিহাসে তা প্রথম দেখা গেছে। এর ধারাবাহিকতায় কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়েছে। সেই মানুষেরাই আজকের সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তুলেছে।
চলতি বছর অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী জোয়েল মোকির, ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট দেখিয়েছেন, উদ্ভাবনই ভবিষ্যৎ অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের গবেষণা মনে করিয়ে দেয়—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয় বা নিশ্চিত প্রক্রিয়া নয়।
অর্থনীতির এই পুরস্কার মূল নোবেল পুরস্কারের অন্তর্ভুক্ত নয়। ১৯৬৯ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে এই পুরস্কার চালু করে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫৭ জন এই পুরস্কার পেয়েছেন। আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্থনীতিতে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরস্কার—এটাই এই পুরস্কারের কেতাবি নাম।
সবচেয়ে বেশি বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছেন লিওনিড হারউইচ। ২০০৭ সালে এই পুরস্কার পাওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ৯০ বছর। তিনি আরও দুজনের সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। সবচেয়ে কম ৪৬ বছর বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছেন এস্থার দুফলো। ২০১৯ সালে স্বামী অভিজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পান তিনি।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি- এই ছয় বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন; তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কার প্রদানের পর তা উদযাপনে উৎসবের আয়োজন করে নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির সদর দফতর নরওয়েতে।
উনবিংশ শতাব্দিতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাজারে যা প্রায় ১৮০ কোটি ক্রোনের সমান। আলফ্রেড নোবেলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।
প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার শুরু হয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। প্রথম দিন ঘোষণা করা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল।
ছয়টি বিভাগে ছয় দিন নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা হয় নরওয়ে থেকে। সাহিত্য ও অর্থনীতির মতো অন্য পুরস্কারগুলো সুইডেন থেকে ঘোষণা করা হয়।
১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।
১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১১৪টি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। ২২৭ জন বিজয়ীর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নারী।
শুরুতে নোবেল বিজয়ীদের প্রায় দেড় লাখ ক্রোনা দেওয়া হতো। বাড়তে বাড়তে ১৯৮১ সালে তা ১০ লাখ ক্রোনা হয়। এরপর পুরস্কারের আর্থিক মূল্য দ্রুত বাড়ানো হয়। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এর পরিমাণ ১ কোটি ক্রোনা হয়।
সর্বশেষ এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাড়ানো হয় নোবেল পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী। এ বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা মোট ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা (৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলার) পাবেন, যা আগের চেয়ে ১০ লাখ ক্রোনা বেশি। নোবেল ফাউন্ডেশনের তহবিলের উন্নতি হওয়ায় এ বছর পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ফাউন্ডেশনের তহবিলে টান পড়ায় ২০১২ সালে পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি ক্রোনা থেকে কমিয়ে ৯০ লাখ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে ৯০ লাখ এবং ২০২০ সালে ফের এক কোটিতে উন্নীত করা হয়।
গত এক দশকে ইউরোর বিপরীতে প্রায় ৩০ শতাংশ দর হারিয়েছে সুইডিশ ক্রোনা। ফলে পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ ক্রোনা বাড়ানো হলেও সুইডেনের বাইরে তা ততটা বাড়বে না।
২০১৩ সালে আর্থিক সম্মানী কমিয়ে ৮০ লাখ ক্রোনা করা হয়। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় এই পুরস্কারের পরিমাণ দাঁড়াত ১২ লাখ ডলার। সেটা বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনা হলেও বিনিময় হারের খেলায় ২০২৪ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ডলারের কম। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান খুব একটা বাড়েনি।
বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার মূল্যমান দাঁড়ায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি।