মিরপুরে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনে নিহত ১৬

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকায় পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রূপনগরে আগুনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জন হয়েছে। প্রথমে ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, পরে আবার সাত জনের মরদেহ নতুন করে উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। 

আজ বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে মিরপুরের রূপনগরে শিয়ালবাড়ী এলাকায় এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। আগুন লাগা ভবনটিতে একটি পোশাক কারখানা এবং একটি রাসায়নিকের গোডাউন (কেমিক্যাল গোডাউন) ছিল বলে এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে। 

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিট) কমপক্ষে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিরা বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়াও কয়েকজন আহত বা দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে। 

আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ১২টিরও বেশি ইউনিট। ভবনটিতে রাসায়নিক থাকায় এবং প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং ভেতরে প্রবেশ করে উদ্ধার কাজ চালাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বেশ বেগ পেতে হয়। 

বিকেলে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তল্লাশি অভিযান এখনো চলমান। পাশের যে কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে, সেখানে এখনো আগুন জ্বলছে। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওখানে কাউকে যেতে দিচ্ছি না। আমরা সর্বোচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে, ড্রোন দিয়ে এসব কার্যক্রম করছি।’

আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো জানা যায়নি। যাঁরা শুরুতে আগুন নেভাতে এসেছেন, তারা রাসায়নিকের গুদাম ও গার্মেন্টস দুই দিকেই আগুন দেখেছেন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, তিনতলা পোশাক কারখানার নিচতলায় ‘ওয়াশ ইউনিট’ রয়েছে। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আগুন তিনতলা পোশাক কারখানার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

মিরপুরে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুনে নিহত ১৬

নিখোঁজ অনেকের সন্ধান পেতে ছবি নিয়ে ঘটনাস্থলে এসেছেন স্বজনরা। তাদের মধ্যে একজন নাসিমা আক্তার। তিনি জানান, ১২ বছর ধরে তার স্বামী নজরুল ইসলাম গার্মেন্টস কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। আগুন লাগার খবর পেয়ে কল দিলে শুধু ‘আগুন আগুন’ বলে ফোন রেখে দেন। তার পর থেকে স্বামীর ফোন বন্ধ পাচ্ছেন। 

রেশমা আক্তার নামে আরেকজন বলেন, নিখোঁজ আসমা আক্তার (১৫) আগুন লাগা পোশাক কারখানায় কাজ করে। মেয়েটি তাঁর ছেলের শ্যালিকা। তাদের সঙ্গে ১০ নম্বর শিয়ালবাড়িতে থাকে আসমা। আগুন লাগার পর থেকে তার খোঁজ মিলছে না।  

এই গার্মেন্টস কারখানাতেই কাজ করতেন ২০ বছর বয়সী রবিউল্লাহ। সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। ছেলের খোঁজে ছুটছেন মা— একবার পুলিশের দিকে, একবার সেনাবাহিনীর কাছে, আবার ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের কাছে। কোথাও থেকে কোনো খবর মিলছে না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলেটা আমার বেঁচে আছে তো? আবার চোখ মুছে তাকাচ্ছেন আগুনের ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা ভবনের দিকে।

রবিউল্লার বড় ভাই হাবিবুল্লাহ বলেন, আমার ভাই এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। যার কাছে যাচ্ছি কেউ কিছু বলতে পারছে না। সকালে আগুন লাগার পর নিচের গেট বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তাই ৩য় ও ৪র্থ তলা থেকে কেউ বের হতে পারেনি। ওই দুই ফ্লোরে প্রায় ১০০ জন ছিলেন।

ঘটনাস্থলে থাকা নিপা নামে এক নারী জানান, তার বোনের ছেলে রবিন পোশাক কারখানার তিন তলায় কাজ করতেন। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর থেকে ওর কোনো খবর নেই। বারবার ফোন দিয়েছি, কোনো সাড়া পাইনি। এখন জানি না, ও বেঁচে আছে কি না।

একইভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাগনি মাহিরার ছবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমার ভাগনি মাহিরা তিন তলায় কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে ওর কোনো খবর নেই। চারদিকে খুঁজেছি, হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি—কোথাও পাইনি।

মিরপুরে আগুনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার শোক

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আজ মঙ্গলবার এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমরা এই শোকের সময়ে তাদের পরিবারের পাশে আছি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বার্তায় এ কথা জানানো হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *