■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল এবং ডেন্টাল কলেজের ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এবার ভর্তি পরীক্ষায় মোট পাসের হার ৬৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ৪৪০ জন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৯৮ দশমিক ২১ শতাংশ। অনুপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থী, যা ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ ছাড়া পরীক্ষাকেন্দ্রে অনিয়মের দায়ে ২ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়।
এবার ভর্তি পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮১ হাজার ৬৪২ জন পরীক্ষার্থী। উত্তীর্ণদের মধ্যে পুরুষ পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ১২৮ জন, যা মোট পাস করা পরীক্ষার্থীর ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। অপরদিকে নারী পরীক্ষার্থী পাস করেছেন ৫০ হাজার ৫১৪ জন, যা ৬১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
আগের বছরের তুলনায় এবার পাসের হার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। নারী পরীক্ষার্থীদের পাসের হার তুলনামূলক বেশি।
ভর্তি সংক্রান্ত পরবর্তী ধাপ, মেধাক্রম অনুযায়ী কলেজ নির্বাচন ও ভর্তির সময়সূচি খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক রুবীনা ইয়াসমীন বলেন, ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট www.dgme.gov.bd এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট www.dghs.gov.bd ও https://result.dghs.gov.bd হতে পরীক্ষার ফল জানতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল অংশে এমবিবিএস-বিডিএসের ২০২৫-২৬ ভর্তি ফলাফল বা ‘MBBS Result 2025-2026’ লিংকে ক্লিক করে ইউজার আইডি আর পাসওয়ার্ড দিতে হবে। এরপর সাবমিট বাটনে ক্লিক করলেই ফলাফল দেখা যাবে। ভর্তিচ্ছুরা এটি ডাউনলোড বা স্ক্রিনশট নিতে পারবেন। মেধাতালিকা ওয়েবসাইটে পিডিএফ আকারেও প্রকাশ করা হয়েছে।
গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর ২০২৫) ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১ লাখ ২০ হাজার ৪৪০ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। অংশগ্রহণের হিসেবে আবেদনকারীর মধ্যে থেকে ৯৮ দশমিক ২১ শতাংশ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। অনুপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থী।
এ বছর লিখিত ভর্তি পরীক্ষায় ১০০টি এমসিকিউ প্রশ্নে (এইচএসসি বা সমমানের সিলেবাস অনুযায়ী) পরীক্ষা হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্ন ১ নম্বর করে মোট ১০০ (একশত) নম্বরের বিষয়ভিত্তিক বিভাজন হলো যথাক্রমে জীববিজ্ঞান-৩০, রসায়ন-২৫, পদার্থ বিজ্ঞান-১৫, ইংরেজি-১৫ এবং সাধারণ জ্ঞান, প্রবণতা ও মানবিক গুণাবলি মূল্যায়ন-১৫। পাস নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ নম্বর। পরীক্ষার সময় গত বছরের তুলনায় ১৫ মিনিট বাড়িয়ে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট করা হয়েছে। লিখিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিটি ভুল উত্তর প্রদানের জন্য ০.২৫ নম্বর কর্তন করা হবে। পাস মার্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ নম্বর।
২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে আসনসংখ্যা ৫ হাজার ৬৪৫টি যার মধ্যে এমবিবিএস ৫ হাজার ১০০ এবং বিডিএস ৫৪৫টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে আসনসংখ্যা ৭ হাজার ৪০৬টি। যার মধ্যে এমবিবিএস ৬ হাজার ১ এবং বিডিএস এক হাজার ৪০৫টি। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মিলিয়ে মোট আসন ১৩ হাজার ৫১টি। যার মধ্যে এমবিবিএস কোর্সে ১১ হাজার ১০১ এবং বিডিএস কোর্স এক ৯৫০টি আসন। ১৩ হাজার ৫১ টি আসনের জন্য এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে এ বছর মোট আবেদনকারী ১ লাখ ২২ হাজার ৬৩২ জন।
মেডিকেলে দেশসেরা জাহাঙ্গীর আলম শান্ত
২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় সারাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন নরসিংদীর সন্তান ও সরকারি বিজ্ঞান কলেজের কৃতী শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম শান্ত। তিনি। ৯১.২৫ নম্বর অর্জন করে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন। তার রোল নম্বর ২৪১৩৬৭১।
ফলাফল প্রকাশের পর সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর আলম শান্ত রেটিনার ফেসবুক পেজে এক ভিডিওতে তার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শান্ত প্রথমেই মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ফাস্ট হওয়ার পরে প্রথমে আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া যে আল্লাহ এত বড় একটা অর্জনে আমাকে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ যেহেতু চাইছেন তাই হইছে। আর অনুভূতি বলতে অনেক ভালো লাগতেছে, যেহেতু আমার পরিবারের সবাই খুশি। বাপ-মাকে আমি গর্বিত করতে পেরেছি এ কারণে খুব ভালো লাগছে।’
শান্তর শিক্ষাজীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে তার নিজ এলাকা নরসিংদীর বেলাবোতে। তিনি উপজেলার বারৈচা রেসিডেন্সিয়াল মডেল হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য ঢাকায় এসে তেজগাঁওয়ের সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। পরিবার ছেড়ে ঢাকায় মেসে থেকে পড়াশোনা করাটা ছিল তার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। কলেজ জীবনের শুরুতে শান্তর ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার। কিন্তু ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রশ্নব্যাংক সমাধান করতে গিয়ে তার আত্মবিশ্বাস জন্মে যে তিনি মেডিকেলেও ভালো করতে পারবেন। সেই থেকেই শুরু হয় তার নতুন লক্ষ্যের দিকে যাত্রা।
প্রস্তুতির সময় শান্ত ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী, বিশেষ করে মোবাইল আসক্তি নিয়ন্ত্রণে তার কঠোর অবস্থান ছিল অনুকরণীয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মোবাইল আমার ফোকাস নষ্ট করছিল। তাই আমি ঠিক করি যে যখন লাগবে তখন, তবে মোবাইল আমার কাছে রাখা যাবে না। তিনি তার ফোনটি বাসার এক আন্টির কাছে জমা রেখেছিলেন এবং কেবল জরুরি ক্লাসের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতেন।
পড়াশোনার রুটিন সম্পর্কে শান্ত জানান, তিনি মূলত সকালের দিকে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তার ভাষায়, ‘আমি সকালে পড়া স্টুডেন্ট। সকাল টাইমটাতে মনে হয় ৫টা থেকে ৮টা- ৯টা, ওই টাইমে পড়াগুলা বেশি মনে থাকে।’
তবে তার এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় অক্টোবরে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১০-১২ দিন পড়াশোনার বাইরে ছিলেন। প্রথমে কিছুটা হতাশ হলেও তিনি দ্রুতই মানসিক শক্তি ফিরে পান।
এ বিষয়ে শান্ত বলেন, প্রথম দিক দিয়ে একটু ডিপ্রেসড হলেও পরে ভাবলাম, আল্লাহ যেহেতু দিছে তাইলে হয়তো আমার এটার মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত আছে। আমি চিন্তা করলাম, এই ১০ দিন আমি যা পড়বো তা তো মেডিকেলে নাও আসতে পারে।
পরীক্ষার হলে শান্ত ছিলেন বেশ আত্মবিশ্বাসী এবং প্রশ্ন সহজ মনে হওয়ায় ১০০টি প্রশ্নেরই উত্তর দাগানোর ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘চান্স পাইলে পাইলাম না পেলে নাই, কিন্তু আমি শুধু প্রশ্নের ভেতরেই ছিলাম। বের হয়ে মিলিয়ে দেখলাম যে ৯২ এর আশেপাশে কারেক্ট।’
এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে মা-বাবার দোয়া এবং বন্ধুদের সমর্থনের কথা উল্লেখ করেছেন শান্ত। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ফ্রেন্ডরা বলতো যে ওরা যে সময় আমার বাড়িতে যাইতো, ওই টাইমে গিয়ে দেখতো যে আমার মা নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করতেছে। এটা শুনলে আমার শরীরে অন্যরকম একটা অনুভূতি আসতো। আমার মনে হতো, আমার মা তো দোয়া করতেছে, আমার কী লাগবে? আমি তো এমনিতেই পারবো।’
এছাড়াও শান্ত তার প্রাইমারির শিক্ষক ও চাচা শামীম স্যারের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন, যিনি শান্তর চান্স পাওয়ার আশায় নফল রোজার মানত করেছিলেন। এমনকি তার বন্ধুরা পরীক্ষার সময় তার জন্য কোরআন খতম ও দোয়া করেছিলেন, যা তাকে মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী করেছিল।
বায়োলজির কঠিন বিষয়গুলো মনে রাখার জন্য শান্ত নিজস্ব কিছু কৌশল অবলম্বন করতেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন ঘটনার সাথে মিলায়া তারপরে বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মানে ওয়ার্ডগুলা ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেভাবে মনে রাখা যায়, বিভিন্ন ছন্দের মাধ্যমে মনে রাখতাম।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে শান্ত জানান, তিনি একজন অনকোলজিস্ট বা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হতে চান। তিনি বলেন, ‘ক্যান্সার বিষয়টা আমার কাছে খুব ভালো লাগে, তো অনকোলজিস্ট হওয়ার একটা ইচ্ছা আছে যদি আল্লাহ কবুল করে।
সর্বশেষে জুনিয়রদের উদ্দেশে শান্ত একাডেমিক পড়াশোনা বা এইচএসসি লেভেলেই মূল প্রস্তুতি গুছিয়ে রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘একাডেমিকে যদি সবকিছু শেষ করে রাখা যায় তবে অবশ্যই আগায়া থাকবে। জীবন আসলে থেমে থাকার নয়, সামনে আরও বহু পথ চলার বাকি। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে, যার আল্লাহর ওপর ভরসা, আল্লাহ তাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।’
