:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
গত ১৯ জুলাই সরকার ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে। সেপ্টেম্বরে একটু কমলেও অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতির আবার অবনতি ঘটে। বর্তমান সময়ে গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি পার করছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আশা করেছিলাম, সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং কমবে। তা হয়নি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখনও অনুকূলে নেই। দাম বাড়ায় গ্যাস আনা যাচ্ছে না। ডলার সংকট ও পিডিবির কাছে বিল বকেয়া থাকায় কমে গেছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর তেল আমদানি; কমেছে উৎপাদন। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমছে না। দিনে যেসব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হয়, সেগুলো রাতে বন্ধ রাখা হচ্ছে। শিল্পে বেশি গ্যাস দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিং বন্ধ করা যায়নি। নভেম্বরের আগে কোনো সুখবর নেই।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘জ্বালানি সংকটে বিদ্যুতের উৎপাদন কম হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম না কমলে পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই।’
তেলের দাম কমার সম্ভাবনা কম
বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম ১০০ ডলারের নিচে থাকলেও পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের দাম আবার বেড়েছে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগেও ব্যারেলপ্রতি ডিজেলের দাম ১১০ ডলারে নেমেছিল। তা আবার ১৪০ ডলারের ওপরে উঠেছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে তেলের দাম কমার সম্ভাবনা কম।
জুলাই-আগস্টে গড়ে দৈনিক ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছিল। এখন এর পরিমাণ তিন হাজার মেগাওয়াট পেরিয়ে গেছে। এর মূল কারণ গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিচ্ছে পেট্রোবাংলা।
জুলাইয়ে দিনে গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যেত ৫৫ কোটি ঘনফুট। কয়েক দিন ধরে এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ কোটি ঘনফুট। এলএনজির কার্গো আসার পরিমাণ কমায় সরবরাহ কমেছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, আগের তিন মাসে পাঁচটি করে এলএনজির কার্গো এলেও অক্টোবরে আসবে মাত্র চারটি।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে। এখানে দুটো ঘটনা ঘটছে। এক, ব্যয় সাশ্রয়ে সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কম চালাচ্ছে। দুই, ফার্নেস অয়েল সংকটে বেসরকারি খাতে উৎপাদন কম হচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে।
ডলার সংকটের কারণে তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বিপ্পার সভাপতি ইমরান করিম বলেন, সরকারের কাছে প্রায় চার মাসের বিদ্যুৎ বিক্রির ১৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে অনেক মালিক ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছেন না। ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে। তিনি জানান, ডলার সংকটের কারণে তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মালিকরা এলসি খুলতে পারছেন না। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের খরচ বেড়েছে। পিডিবি আগের দরেই বিল দিচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদ্যুৎ বিল পান ডলারে। পূর্ব চুক্তি অনুসারে প্রতি মার্কিন ডলার ৮৪ টাকা ধরে তাঁদের বিল পরিশোধ করে পিডিবি। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায় ব্যবসায়ীরা ডলারপ্রতি টাকার পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। তবে অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও জানায়নি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা তেল আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে এমন ছাড় দিলে অন্য উদ্যোক্তারাও এমন দাবি জানাবে, যা অর্থ খাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে।
আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
দেশের ১৩৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট। গ্যাসচালিত ৫৭ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কম হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত ৫৬ কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫ হাজার ৫৪১ মেগাওয়াট। ডিজেলের ১১ কেন্দ্রের ক্ষমতা ১ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র থেকে দিনে গড় উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪ হাজার মেগাওয়াট। এর বাইরে মেরামত ও সংরক্ষণের কারণে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং
পিডিবির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, গত সোমবার দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৯২৩ মেগাওয়াট। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৯০১ মেগাওয়াট। পিডিবির দাবি, সারাদেশে লোডশেডিং হয়েছে ৯৪২ মেগাওয়াট। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য বলছে, দেশে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ঘাটতির পরিমান ছিল এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর বাইরে আরও চারটি বিতরণ কোম্পানি রয়েছে।
রাজধানীতে লোডশেডিং বেড়েছে
রাজধানীতে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ (ডিপিডিসি) জানিয়েছে, তাদের এলাকায় এখন দিনে চার থেকে পাঁচবার লোডশেডিং হচ্ছে। জুলাই-আগস্টে দিনে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং করতে হয়েছিল। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান গতকাল সমকালকে জানান, তাঁদের চাহিদার চেয়ে ৪০০-৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। ফলে বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
গ্রামের লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন
নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় থাকা বেলাব উপজেলায় সোমবার রাত ২টা থেকে বিদ্যুৎ যাওয়ার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ভোর ৬টায় আসে। সকাল সাড়ে ৮টায় লোডশেডিং শুরু হয়ে থাকে ১১টা পর্যন্ত। ৭ মিনিট পর ১১টা ৮ মিনিটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে চালু হয় ১১টা ২৬ মিনিটে। দুপুর ১টা ৩৪ মিনিটে গিয়ে আসে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টা ৩৪ মিনিটে। রাত ১০টা ৫০ মিনিটে গিয়ে আসে ১১টা ৫৪ মিনিটে। মঙ্গলবার রাত দেড়টায় বিদ্যুৎ গিয়ে ফিরে আসে রাত আড়াইটায়। মঙ্গলবার ভোর ৫টা ১৪ মিনিটে গিয়ে আসে ৫টা ১৯ মিনিটে। দেশের প্রায় সব উপজেলা ও গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের এমনই ছবি। গ্রামে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছেই না।
গরমের তীব্রতা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে না
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নভেম্বর থেকে লোডশেডিং কমতে পারে। সংশ্নিষ্টদের মতে, মূলত আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সরকার। গরমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। শীত শুরু হলে এই লোড কমে আসবে। তখন তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট চাহিদা কমবে। ফলে লোডশেডিং তেমন থাকবে না।
এ ব্যাপারে নসরুল হামিদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, গরমের তীব্রতা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাপমাত্রা কমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, শীতে চাহিদা কমলে লোডশেডিং কম হবে। তবে আগামী মার্চে গরম ও সেচ মৌসুমের কারণে চাহিদা ফের বাড়বে। তখন পরিস্থিতি আবার আগের আবস্থায় ফিরবে, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন না বাড়ে। তিনি বলেন, এ সময়ে যদি রামপাল ও ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।