:: নাগরিক প্রতিবেদক ::
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
শুক্রবার (৩১ মার্চ) আসক প্রকাশিত তিন মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। দশটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম এবং আসকের নিজস্ব সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে বুধবার ভোর রাতে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং দিনভর তাকে আটকের ঘটনা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায়োগিক আচরণ অসঙ্গত ও বেআইনি।
এ ধরনের নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের অভিযোগ সাতক্ষীরায় কর্মরত সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে আটকের সময়ও পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছিল। রঘুনাথকে আটকের পর পুলিশ দিনভর অস্বীকার করে, প্রায় নয় ঘণ্টা পর তাকে একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সে বিষয়টি তুলে ধরে আসক বলছে, এ ধরনের মামলা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করবে এবং সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবে।
এ ছাড়া গুলশানের বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ সংগ্রহকালে কালের কণ্ঠের সাংবাদিক জহিরুল ইসলামকে গুলশান থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন।
গত তিন মাসে ১২৪ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। আত্মহত্যা করেছেন ১ জন নারী। ৩৪ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১১৬ জন নারী। তাদের মধ্যে ৬৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং আত্মহত্যা করেছেন ৩০ জন। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন নারী।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন মাসে মোট ৩৫৩ শিশু নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৫২ শিশু। এক ছেলে শিশুকে বলাৎকারের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ২৫ শিশু। বিভিন্ন সময়ে মোট ৪৫ শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৩ শিশুর। এছাড়া বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৭ ছেলে শিশু এবং বলাৎকারের চেষ্টা করা হয়েছে ৩ জন শিশুকে।
সীমান্ত হত্যার বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৫ বাংলাদেশি। আহত হয়েছেন ৬ জন।
আসক মনে করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পায় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আসক রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের সব ধরনের মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত তিন মাসে দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন পুলিশ কর্তৃক এবং দুজন র্যাব কর্তৃক নিহত হয় বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে র্যাব ও পুলিশের শারীরিক নির্যাতনে দুজন এবং র্যাবের গুলিতে একজন নিহত হন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের প্রথম তিন মাসে পাঁচটি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটি বাড়িঘরসহ একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ১৫টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ১ জন নিহত ও কমপক্ষে ৬২ জন আহত হয়েছেন। ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে’ কমপক্ষে ১০৩টি বাড়ির ২৫৯টি ঘরে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। ৩৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
গত তিন মাসে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন মোট ১১ জন। এরমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৫ জন করে এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন নিহত হন।
বিগত তিন মাসে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১০২টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১৩৭৪ জন।
গত তিন মাসে ১০৫ জন নারী ও পুরুষ ‘যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক সহিংসতার’ শিকার হয়েছেন বলে তথ্য এসেছে আসকের প্রতিবেদনে। তাঁদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ৪০ জন নারী এবং ৬৫ জন পুরুষ। এর মধ্যে বখাটের হাতে লাঞ্ছিত ২৮ জন, বখাটেদের উৎপাতকে কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছেন ৬৪ জন।
আসক বলেছে, গত তিন মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ২৬ জন, তাঁদের মধ্যে ১১ জন কয়েদি এবং ১৫ জন হাজতি।