:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে অভিযান নিয়ে তথ্য বিকৃতির অভিযোগে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
একইসঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে, যা অনাদায়ে আরও ১ মাসের কারাদণ্ড হবে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত এ রায় ঘোষণা করেন।
২০১৩ সালে দায়ের হওয়া এই মামলার আসামি অধিকারের সম্পাদক আদিলুর এবং সংগঠনটির পরিচালক নাসির। তারা দুই জনই জামিনে ছিলেন।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ৬১ জন নিহত হওয়ার কথা দাবি করেছিল অধিকার। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই সংখ্যাটি ১৩ বলে জানানো হয়।
সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে ওই বছরের ১০ জুন সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে সেটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।
গত ২৪ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৭ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন বিচারক। তবে ওই দিন তা প্রস্তুত না হওয়ায় বিচারক রায় ঘোষণা পিছিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন। রায় ঘোষণার সময় দুই আসামি আদিলুর ও এলান আদালতে হাজির ছিলেন।
২০১৩ সালে ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলাম সমাবেশ করে। পরে সমাবেশস্থলে রাত্রিযাপনের ঘোষণা দেয় সংগঠনের নেতারা। তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে যৌথ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছিল অধিকার। তবে সরকারের ভাষ্য সেই রাতের অভিযানে কেউ মারা যায়নি। শাপলা চত্বরে অভিযানের পর ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন ডিবির তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল ইসলাম।
তদন্ত শেষে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালতে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এতে ৩২ জনকে সাক্ষী করা হয়। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য অভিযোগ আমলে নেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২০১৪ সালে দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি আদিলুর ও এলান ৬১ জনের মৃত্যুর ‘বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা’ তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপচেষ্টা চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করে।’
‘পাশাপাশি তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে, যা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ও (২) ধারায় অপরাধ। একইভাবে ওই আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা চালায় এবং সরকারকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালায়।
আদিলুর-এলানের মুক্তি দাবি অ্যামনেস্টির
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র ও সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের মুক্তি দাবি করেছে অ্যামনেস্টি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের এক্স একাউন্ট (সাবেক টুইটার) থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে একটি পোস্ট দেয়া হয়। বাংলাদেশের আইসিটি আইনের সমালোচনা করে অধিকারের দুই সদস্যের মুক্তি দাবি করে অ্যামনেস্টি।
প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, এক দশক ধরে রাষ্ট্র কর্তৃক অভিযোগ ও নিপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার পর আজ ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নেতা আদিলুর রহমান খান এবং এ এস এম নাসিরুদ্দিন এলানকে কড়া (ড্র্যাকোনিয়ান) আইসিটি আইনে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। অধিকার ২০১৩ সালে একটি বিক্ষোভ দমনের সময় রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নথিভুক্ত একটি তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশের পর মামলাটি দায়ের করা হয়। অধিকার ও এর নেতাদের ওপর রাষ্ট্রের এমন অব্যাহত দমন-পীড়ন সত্য বলার অধিকারের ওপর আঘাত। এরপরই অ্যামনেস্টি বলে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথিভুক্ত করা কোনো অপরাধ নয়। আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে আদিলুর রহমান খান ও এলানকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ করছি।
বৃহস্পতিবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায় পড়ার সময় আদালতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বৃটেন ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের পর্যবেক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতামত জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা রায় পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি। সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর না দিয়ে তারা বলেন, আমরা শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে আদালতে এসেছি।
আদিলুর-এলানের কারাদণ্ডের রায়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ করা হয়। কারাদণ্ড ছাড়াও আদিলুর ও এলানকে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষায় সুশীল সমাজ এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থাগুলো যে ভূমিকা পালন করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার সম্পর্কিত ‘অনলাইন এবং অফলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক ২০২২ সালের কান্ট্রি রিপোর্ট তুলে ধরে বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে—বাংলাদেশের মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে পরিচালিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে অধিকার-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আদালতের রায় মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং সুশীল সমাজের গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের ইচ্ছাকে আরও সংকুচিত করতে পারে বলে মনে করছে মার্কিন দূতাবাস।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “গত কয়েক দশক ধরে যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন ‘অধিকার’ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট করেছে। আমরা গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং একটি প্রাণবন্ত সুশীল সমাজকে সমর্থন করে যাচ্ছি এবং সেই মৌলিক অধিকারগুলোর প্রয়োগ সীমিত করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছি। ”