:: ফয়েজ আহমদ তৈয়ব ::
বিএনপি এখন কয়েকটা মূল কাজ তুলে ধরা হল।
এক। বিদেশ নির্ভরতা বাদ দিয়ে নিজের শক্তি ও প্রস্তুতিতে নজর দেয়া।
দুই। ব্যক্তি নির্ভরতা বাদ দিয়ে সংগঠন বিকাশ করা। নেতা নির্ভর কর্মী বিএনপিকে হেল্প করছে না। বিএনপির সমস্যা ডেলিগেশান না থাকা। উপরের স্তর থেকে নিচের কাজ করা হয়, মিড ম্যানেজমেন্টের কাজ থাকে না, অথোরিটি ও ডেলিগেশান থাকে না। উপরের স্তর গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় দেয় না। নেতা জেলে গেলে কর্মীরা প্রোগ্রামে আসে না। দলীয় কোন্দলে এক নেতা অন্য নেতার প্রোগ্রামে কর্মী দেয় না। ছাত্র যুব শ্রমিক কৃষক দলের ভয়েস নাই। এসব কাটাতে হবে। ছাত্রদল যুবদলসহ সমস্ত অঙ্গ সংগঠনের মিড ও লোয়ার লেভেলের সব সভাপতি সম্পাদক স্থানীয় তৃণমূল দ্বারা নির্বাচিত করে কর্মীদের এমপাওয়ার করতে হবে। পদ বিক্রির বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, টপ লিডার অপারেশন্স ম্যানেজারের ভূমিকা নেন, কিন্তু সিইওর মত ভূমিকা নেন না। এই ম্যানেজমেন্টকে সংস্কার করতে হবে।
তিন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ, প্রতিপক্ষের শক্তি, তার আন্তর্জাতিক কানেকশন এবং তার শক্তি প্রয়োগের কৌশলকে রাইট এসেস করা এবং ‘যদি মানুষ নেমে যায়’এমন নিয়তির কাছে ছেড়ে না দেয়া। মানুষের কালেক্টিভ মেমোরিতে ‘বিএনপি’ নিয়ে আস্থা নাই, বিএনপি আসলে বেটার কী করবে-এটাকে এড্রেস করতে হবে সৎ ভাবে, যোগ্য লোক দিয়ে।
চার। ছায়া সরকার গঠন করে, পলিটিক্যাল ন্যারেটিভে শুধু ভোটাধিকারভিত্তিক আলাপ ও বয়ানে সীমাবদ্ধতা কাটানো। আন্দোলনের পাশাপাশি ছায়া সরকার গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে হেয় করলে বিএনপি আবারও পিছিয়ে পড়বে প্রস্তুতিতে এবং জন স্বার্থ সম্পর্কে।
আন্দোলনের নামে, হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। ক্রেডেবিলিটি নষ্ট হয়, দল ও নেতার উপরে মানুষের আস্থা কমে যায়- এমন অবাস্তব কোন সিদ্ধান্ত ও ডাক দেয়া যাবে না। এজন্য সব সিদ্ধান্ত আগেই বিভিন্ন স্তরে চেক ও ভেটিং করে নিতে হবে।
পাঁচ। ৯০% মানুষ ভোট বয়কট করেছে। সবার আগে এই মোরাল ভিক্টোরি ক্লেইম করতে হবে। সর্বত্র এই ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দিতে হবে যে, আওয়ামীলীগের রিজার্ভ ভোটারের তত্ত্ব ধ্বসে পড়েছে। জনতার নির্বাচন বয়কটকে গ্লোরিফাই করতে হবে। বিদেশ নির্ভরতা এবং ভুসিমালের ছড়ানো মিথ্যা হাইপ- ছাড়া বিএনপি এবার ভাল করেছে। ফাও ও মিথ্যা আশা বিক্রি করার অপনেন্ট ও তার ঘরের বাইরের মিত্রদের শক্তির রাইট এস্টিমেট হয় না, আরেকটু ঝাকা দিলে পড়ে যাবে সব ছাইপাশ বক্তব্যকে উষ্ঠা মেরে প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে।
ছয়। পাশাপাশি মিসিং লিংকগুলো ফিল করা। বিএনপি দেশ ও বিদেশের অনেক ডোমেইনের সাথে ডিস্কানেক্টেড। ডিপ্লোমেট, এনজিও, কর্পোরেট, গবেষণা সংস্থা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, আমলা, রাজনৈতিক দল, বিরুপ হলেও মিডিয়ার সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে ও সম্পর্ককে নার্চার করতে করতে গ্রো হবে। এমনি এমনি কেউ বিএনপিকে স্পেইস দিবে না। এখন তাদের সফট পাওয়ার তৈরির বিকল্প নাই।
শহুরে তরুণদের কেন বিএনপি টানতে পারছে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কেন বিএনপির দাবীকে ওউন করে না, তার স্ট্যাডি দরকার। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক বক্তব্যের ভাষা ছিল মার্জিত, আজকে সেটা দেখা যায় না। অমার্জিত উত্তেজক ভাষা এবং কন্টেন্টহীন গতানুগতিক একঘেয়ে কথাবার্তা আমাদের তরুণদের টানছে না। আমি এটাও দেখেছি শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করে দেয়া ক্রমাগত একই ধারার বক্তব্যেও তরুনরা বিরক্ত। তাঁদের চ্যালেঞ্জ গুলোকে এড্রেস করতে হবে বিএনপিকে।
তরুনরা বিএনপির কাছে কী চায় এটা ব্যাপকভাবে সার্ভে করতে হবে। তাঁদের ক্যাচি মেসেজ দিতে হবে, তারা কী চায় তাঁর যৌক্তিক অংশগুলোকে পলিসিতে নিয়ে সেভাবে ন্যারেটিভ তৈরি করে তাদের মন জয় করতে হবে। এমন একট স্তরের সফট পাওয়ার তৈরি করতে হবে যাতে বড় অঘটন হলেও তারা বলবে- বিএনপির আসলে আর কোন উপায় ছিল না। অর্থাৎ ‘পলিটিক্স ইজ দ্য আর্ট অফ বিল্ডিং ন্যারেটিভস’ এই মন্ত্রে ফিরে যেতে হবে।
আর্বান মিডল ক্লাস বিএনপির ন্যারেটিভ যাতে গ্রহণ করে সে সিচুয়েশন তৈরি করতে হবে, এজন্য মিসিং লিংকগুলো ফিল করতে হবে। এটা স্বীকার করতে হবে যে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিএনপির বহু মিসিং লিংক আছে।
বিএনপির সিদ্ধান্ত তৈরির প্রক্রিয়া ব্যক্তি নির্ভর বুদ্ধিজীবী থেকে সরিয়ে বিধিবদ্ধ গবেষণা সংস্থা নির্ভর করার সময় হয়েছে, যেখানে সার্ভে জরিপ সমীক্ষা বেজড সিদ্ধান্ত হবে। অন্যথায় বার বার সিদ্ধান্ত এবং আন্দোলন পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন পর্যায়ে চলে, তখন ব্রেক দেয়া যায় না।
অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য নিতে হবে একাধিক গবেষণা সংস্থার, গবেষণা সংস্থার জরিপ করবে। সিমুলেশন মডেল বানাবে। এতে সম্ভাব্য সিদ্ধান্তকে আগেই পাবলিক ও একাডেমিকলি ভেটিং করা যাবে। মানুষ সিদ্ধান্ত দান প্রক্রিয়ায় থাকবে এবং সিদ্ধান্ত লীক হবার বিষয়টি গৌণ হয়ে উঠবে।
প্রচুর সফট পাওয়ার তৈরি করা বিএনপির বড় কাজ। সফট পাওয়ার তৈরি করতে পারলে এনজিও, মিডিয়া, শিল্পী, আর্টিস্ট, লেখক গবেষণা সংস্থা কর্পোরেট সর্বত্র পার্টনার তৈরি করা সহজ হবে। পার্টনার সাইলেন্ট হলেও সমস্যা নাই। এদের যারা আওয়ামী লীগকে বেনিফিট অফ ডাউট দেয়া তাদের নিউট্রাল করা বড় কাজ। দেশি মিডিয়ার সাথে সংলাপ করতে হবে বিএনপিকে। গণতন্ত্র উদ্ধারে সাংবাদিক সম্পাদকদের সাহায্য চাওয়া, চিঠি দেয়া। চরম প্রতিকূল পরিবেশে তাঁদের কাজের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ দেয়া।
বিদেশি কিছু মিডিয়ার সাথে কানেক্সন তৈরি করা। আর্বান এলিট, মধ্যবিত্তের জন্য মেসেজিং করা, বেকারদের জন্য শ্রমিকদের জন্য মেসেজিং করা, ছাত্রদের টার্গেট করে সফট পাওয়ার ডেভেলপ করা। অর্থাৎ এমন সফট পাওয়ার তৈরি করতে হবে যখন চরম মূহুর্তেও সমর্থন পাওয়া যাবে। মানুষও বুঝবে বিএনপির আর কিছুই করার ছিল না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লিডারদের নিয়ম হলো সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলোর অন্তত একটা সরাসরি লিডার নিজে হ্যান্ডেল করবেন। বিএনপি ও তার নেতাদের ক্ষেত্রে প্রতিটা হ্যান্ডেল এমন লোকেরা করে যাদের প্রত্যেকটা অবস্থান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। গুজববাজ সরিয়ে এসব যোগ্য সাংবাদিকদের টিমে নিতে হবে, ফেসবুক ও টুইটারের অন্তত একটা সরাসরি লিডারকে চালাতে হবে, দেশের প্রতিটি বিষয়কে এড্রেস করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে হবে। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ঘটনা ও ইভেন্ট দিয়ে কানেক্ট হয়। সবাইকে কানেক্ট করতে হলে সব ব্যাপারের সাথে রাজনৈতিক সংস্কারের বিকল্পকে সংযোগ করে বক্তব্য দিতে হবে, বলতে হবে আমরা এটা এভাবে করতাম, আমরা এভাবে করবো।
ভুসিমালদের হাতে কমিউনিকেশন ছেড়ে দিয়ে মানুষের কাঠগড়ায় উঠতে হবে খোদ লিডারকে। বিএনপির প্রতিটি উইংকে ভয়েস দিতে হবে। ভুল প্রেডিকশান দেয়ায়, ভুল বয়ান ও মিথ্যা হাইপ তৈরি করে বিএনপির প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্ত তৈরির প্রক্রিয়াকে ভুল পথে নেয়া সব উপদেষ্টাকে ফায়ার করতে হবে। উপদেষ্টা ব্যক্তি নির্ভর না হয়ে প্রতিষ্ঠান নির্ভর করতে হবে, দরকারে প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে।
গণতন্ত্র পুন: প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কঠিন ও দীর্ঘ। প্রতিবেশীর শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সরকারও চরম ক্ষমতাবান। এটার বাংলাদেশের জন্য আনফরচুনেট। তথাপি দীর্ঘ আন্দোলনের জন্য নিজের দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সংগঠন প্রমোশানের মাঠ প্রস্তুতির বিকল্প নাই।
লেখক: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও গবেষক