■ আবুল হাসান ■
স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে একদিন নিজ দেশেই এমন নির্মম নির্যাতনের শিকার হবো। আমি শুধু লিখেছিলাম সত্য, উচ্চারণ করেছিলাম জনগণের কণ্ঠস্বর। কিন্তু সেই সত্য উচ্চারণের জন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট, বিশেষ করে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা আমার জীবনকে এক দুঃস্বপ্নে পরিণত করেনি, আমার ৭/৮ বছরের ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছিলো। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট মূলত বিরোধীদলের ভয়েস দমন এবং জঙ্গি নাটকের মঞ্চস্থ করার অন্যতম বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম অন্যতম কারিগরদের একজন। টাকলা মনিরুল আসাদুজ্জামানদের বিভিন্ন নাটক মঞ্চায়নের মূল কারিগর এরাই! অতিরিক্ত কমিশনার আলিমুজ্জামান, সহকারী-পুলিশ কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ, ওসি নাজমুল নিশাত! সিটিটিসিতে নিরস্ত্র ওসি যারা আছেন তারা মূলত মামলার তদন্ত কর্মকর্তার নামে নাটকের স্ক্রিপ রাইটার। তারা তাদের ইচ্ছেমত যাকে যেভাবে খুশি সেভাবেই উপস্থাপন করতে পারে।
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম ৫ আগষ্টের পরে পালিয়ে থাকলেও পরবর্তিতে কাজে যোগদান করেই ভাগিয়ে নিয়েছে পদন্নোতি! বর্তমানে উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটি-এ্যাডমিন এন্ড লজিস্টিকস্ বিভাগ), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকায় কর্মরত অর্থাৎ সে সিটিটিসির ডিসি – এডমিন হিসেবে আছে। পাবলিক ভয়েস বলতে যাই বোঝায় ফেসবুকে তৎকালীন সময়ে যে কয়জন সরকার বিরোধী লেখালেখি করতো তার মধ্যে আমিও একজন নগণ্য ছিলাম। ভারতীয় ‘র’, সিলেটে ভারতীয় ‘র’ এর কার্যক্রম, নায়ক অনন্ত জলিলের ইসরাইল কানেকশনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিউজ তৎকালীন সময়ে আমি করেছিলাম আমার নিউজ পোর্টালে, যেগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
নাজমুল নিজে লাঠি দিয়ে আমার ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল। আমি বেহুঁশ হয়ে গেলে আমার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয় কিচ্ছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে আবারও পেটাতে শুরু করতো। আমার হাত, পা, পিঠ, বুক—কোনো অংশই বাদ যায়নি তার হিংস্রতার হাত থেকে। এক পর্যায়ে সে আমার পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে বলছিল, “তোর সত্যি বলার নেশা কেটে যাবে! আর লেখবি? আর ফেসবুকে পোস্ট দিবি?” তার চোখে ছিল এক ধরনের বিকৃত আনন্দ, যেনো একজন নিরপরাধ মানুষের উপর এই অমানবিক নির্যাতন করে সে এক পরম তৃপ্তি পাচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম মানুষ মানুষকে এতোটা নির্যাতন করতে পারে? মনে মনে আল্লাহ্র কাছে আকুতি করছিলাম। আমার দেহের প্রতিটি কোষ সেই ব্যথার সাক্ষী হয়ে আছে। এতটাই মারধর করা হয়েছিল যে কয়েকদিন আমি নড়তে পর্যন্ত পারিনি। কোমরের নিচ থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যে আমি বসতেও পারতাম না। নামাজ পড়তে হলেও হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে পড়তাম। কিন্তু আমার মনোবল ভাঙেনি। আমি নিজেকে ধরে রেখেছিলাম মাহমুদুর রহমানের ‘জেল থেকে জেলে’ বইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। নিয়মিত ব্যায়াম করতাম রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য, বন্দি সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলতাম, হাসতাম, যাতে কষ্ট ভুলে থাকতে পারি।
এইরকম আরও অনেকে ফেসবুকে ও অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব ছিলেন, আর তাদেরকেই টার্গেট করে বিভিন্ন কৌশলে দমন করে নাজমুলের নেতৃত্বাধীন সিটিটিসির ইউনিট। ২০১৮ সালের ২৩শে অক্টোবর গভীর রাতে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় অজানা গন্তব্যে। স্বাভাবিকভাবে আমি ভেবেছিলাম আমাকে শাহপরান থানায় নিয়ে যাবে, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম আমাকে ঢাকার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনই মনে হলো—এটি শুধুমাত্র গ্রেফতার নয়, এটি পরিকল্পিত গুম। সেই যাত্রা ছিল এক অন্ধকারের পথে যাত্রা, যার শেষ কোথায় তা তখনও জানতাম না। রাস্তায় এসআই খালেকুজ্জামান (নামটা দুই তিনদিন পরে জেনেছিলাম) মোবাইল চেক করেছিলো অনেক হাইপ্রোফাইল ব্যাক্তির সাথে ওয়াটসাপে ম্যাসেজ দেখে আশ্চর্য হয়েছিলো এবং একটা সময় সে নিশ্চিত হলো যে আমি জামায়াত করি। তার উর্ধতন কর্মকর্তাকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো স্যার শালায় শিবির করে গাড়ি সাইড করেন ফালাইয়া দেন, আল্লাহ্র কসম মুখের উপরে বলছি ফেলে দেন। সেই সময় এতো সাহস কিভাবে সঞ্চার হয়েছিল মাঝে মাঝে আমিও চিন্তা করি। আল্লাহ্ তায়ালা সেই সময়টায় অসীম সাহসের অধিকারী করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্।
সকাল ১০টার দিকে আমাকে নিয়ে পৌঁছায় ঢাকার ডিএমপি কার্যালয়ে। গাড়ি থেকে নামিয়ে ৫ম তলায় নিয়ে যাওয়া মাত্রই শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। কথা বলার সুযোগ তো দূরের কথা, বুকের সঙ্গে বুক চেপে ধরে জুয়েল নামে এক অফিস কেরানী যেন আমি নড়তে না পারি। নাজমুল নিশাত নামে এক অফিসার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠি দিয়ে শুরু করে আঘাত, আমাকে ধরে রাখতে না পেরে জুয়েল ছেড়ে দেয়, তখন শুরু হয় ঘুষির পর ঘুষি আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম—আমার অপরাধ কী?
এরপর আমার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ, মোবাইল, হার্ডড্রাইভ—সব চেক করা হয়। ল্যাপটপ চালু করতে পারলেও ডেস্কটপে ডিসপ্লে সংযোগ দিতে পারেনি, কারণ তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ডিভিআই ক্যাবল ছিল না। এ কারণে আমাকে আরও মারধর করা হয়। তখনও বুঝতে পারিনি, আমাকে গুম করা হয়েছে। আমার পরিবার জানতেও পারেনি আমি কোথায় আছি। আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখি আমাকে গ্রেফতারকালীন সময়ে বাসা থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে যায় এবং সেই টাকা গাড়িতে বসেই ভাগভাটোয়ারা করে নিয়ে যায় এসআই খালেকুজ্জামান, অজয় কুমার (যে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো) সহ অন্যান্য পুরো টিম।
দুপুরের পর যখন আমাকে নাজমুল ইসলামের অফিসে নেওয়া হয়, তখন শুরু হয় ভয়ংকর নির্যাতনের দ্বিতীয় ধাপ। আমাকে উপস্থাপন করা হয় যেন আমি কোনো বড় অপরাধী। এরপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। একজন অফিসার বলে দিল—আমি জামায়াত করি, আমি নাকি দলের বড় নেতা! ব্যস, এই কথার পর তারা পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
নাজমুল নিজে লাঠি দিয়ে আমার ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল। আমি বেহুঁশ হয়ে গেলে আমার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয় কিচ্ছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে আবারও পেটাতে শুরু করতো। আমার হাত, পা, পিঠ, বুক—কোনো অংশই বাদ যায়নি তার হিংস্রতার হাত থেকে। এক পর্যায়ে সে আমার পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে বলছিল, “তোর সত্যি বলার নেশা কেটে যাবে! আর লেখবি? আর ফেসবুকে পোস্ট দিবি?” তার চোখে ছিল এক ধরনের বিকৃত আনন্দ, যেনো একজন নিরপরাধ মানুষের উপর এই অমানবিক নির্যাতন করে সে এক পরম তৃপ্তি পাচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম মানুষ মানুষকে এতোটা নির্যাতন করতে পারে? মনে মনে আল্লাহ্র কাছে আকুতি করছিলাম।
আমার দেহের প্রতিটি কোষ সেই ব্যথার সাক্ষী হয়ে আছে। এতটাই মারধর করা হয়েছিল যে কয়েকদিন আমি নড়তে পর্যন্ত পারিনি। কোমরের নিচ থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যে আমি বসতেও পারতাম না। নামাজ পড়তে হলেও হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে পড়তাম। কিন্তু আমার মনোবল ভাঙেনি। আমি নিজেকে ধরে রেখেছিলাম মাহমুদুর রহমানের ‘জেল থেকে জেলে’ বইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। নিয়মিত ব্যায়াম করতাম রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য, বন্দি সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলতাম, হাসতাম, যাতে কষ্ট ভুলে থাকতে পারি।
শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, আমার আর্থিক স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়। আমার ফেসবুক, অনলাইন পোর্টাল, ব্যবসায়িক একাউন্টের (বিদেশী ক্লাইন্টের হোষ্টিং) সব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সিটিটিসি ইউনিট। তারা আমার কম্পিউটার, মোবাইল, পাসপোর্ট, আইডি কার্ড, মানিব্যাগ—সব কিছু কেড়ে নেয়। বিকাশ ও ব্যাংক একাউন্টের টাকা তুলে নেয়, এমনকি আমার ফেসবুকের আর্নিংয়ের ৫,৫০০ ডলারও আত্মসাৎ করে। ক্যাশ সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা ভাগভাটোয়ারা করে খেয়ে নেয়। তারা আমার ফেসবুক একাউন্টকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে, বিজ্ঞাপন চালায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। মামলার জব্দ তালিকায় ল্যাপটপ একটি মোবাইল ফোন ও পাসপোর্ট জব্দ উল্লেখ করলেও ডেস্কটপ, আইফোন মোবাইল জব্দ তালিকায় উল্লেখ করেনি। আইডি কার্ড ছিড়ে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক কার্ড গুলো আর পাইনি। ১৪০ পৃষ্টার বেশি অনলাইন নিউজ ও ফেসবুকে শেয়ার করা পোস্ট এভিডেন্স হিসাবে উল্লেখ করেছিলো যেগুলো সরকারবিরোধী।
এডিসি নাজমুল এবং তার বাহিনী তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনলাইনে উপার্জন করা ব্যক্তিদের টার্গেট করত। সামান্য সরকারবিরোধী পোস্ট পেলেই তাদের তুলে আনত, নির্যাতন করত, আর তাদের ডিভাইস ও টাকা ভাগাভাগি করে নিত।
১১ দিন গুম, ৫ দিনের রিমান্ড সহ (আইওর দেওয়া ৩ দিনের রিমান্ড আদেশে সাইন করে আমাকে সিএমএম কোর্টের ম্যাজিষ্ট্যাট আসাদুজ্জামানের সামনে মামলার আইও জিজ্ঞাসা করছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিবে নাকি আবারো রিমান্ডে যাবে সাইন করা আদেশ পেপার দেখিয়ে! কোন কিছু চিন্তা করিনি ১৬ দিনের অভিজ্ঞতায় তড়িৎ সিদ্ধান্ত ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলাম) প্রায় ছয় মাস পর মুক্তি পেলেও আমার জীবন আর স্বাভাবিক ছিল না। আমাকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে, কারণ আমার পরিবারকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হতো। আজও আমার মা সেই আতঙ্ক থেকে বের হতে পারেননি। জেল থেকে বের হয়ে সাড়ে ৩ বছর দেশে ছিলাম কিন্তু আমি অফলাইন ফোন ব্যবহার করতে পারিনি। আমার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিলো যাতে আমি বিদেশে আসতে না পারি। দালালের মাধ্যে পাসপোর্টের কপি দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে এয়ারপোর্ট কন্টাক্ট করে দেশ থেকে একরকম পালিয়েই এসেছিলাম। দুবাইতে আসার পরে সেখানেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছি আল্লাহ্র রহমতে অবশেষে সেখান থেকে বর্তমানে কানাডায় আছি। দেশ স্বাধীন হলেও এখনো পরাধীন, জানিনা আর কবে দেশে ফিরবো আদো ফিরতে পারবো কি না আল্লাহ্ ভালো জানেন।
সত্যি বলতে, এই ঘটনা লেখার পর হয়তো কয়েক সপ্তাহ ঘুমাতে পারব না। পুরনো স্মৃতিগুলো আবার ফিরে আসছে, বুকের ভেতর চাপ অনুভব করছি। এতদিন নিজেকে নিরব রেখেছিলাম, কিন্তু গতকাল ডাঃ জুবায়ের ভাইয়ের লেখা পড়ে মনে হলো, আর চুপ করে থাকা উচিৎ নয়। এই নাজমুল আমার মতো আরও কতশত নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংস করেছে, তার হিসাব নেই। সেলের মধ্যে থাকা অন্যতম সঙ্গী মুর্শেদ মিয়াজী ভাই একজন।
আজও যদি চুপ থাকি, তাহলে হয়তো কোনো দিনই আর কথা বলা হবে না। তাই আমি লিখতে শুরু করেছি। ইনশাআল্লাহ, স্বাধীন দেশের গুম কমিশনে অভিযোগ দায়ের করব। এতদিন প্রবাসের ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে দেরি করেছি, কিন্তু এবার আর নয়। সময় এসেছে, সত্য প্রকাশ করার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর।
আমি লিখবো, আমি লড়বো—ইনশাআল্লাহ।