আয়নাঘর পরিদর্শনে মিলল নির্যাতন ও মানবাধিকার হরণের চিত্র

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের সময় সাথে ছিলেন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী ও ভুক্তভোগীরা।

ড. ইউনূস বলেন, মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলতে গিয়ে কিছু আছে, সেটা থেকে বহু গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। যাতে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ না থাকে। প্রতিটি জিনিস এখানে যা হয়েছে নৃশংস, যতটা শুনে অবিশ্বাস্য মনে হয় এটা কী আমাদেরই জগৎ? এটা আমাদেরই সমাজ? আমরাই এটা করলাম?

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যারা এটার শিকার হয়েছে তারা আমাদের সঙ্গে আছেন, তাদের মুখে শুনলাম কীভাবে হয়েছে। কোনো ব্যাখ্যা নাই। এটা বিনা কারণে। বিনা দোষে। কতগুলো সাক্ষী ঢুকিয়ে দিয়ে বলছে যে তুমি জঙ্গি। এগুলো বলে বলে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এরকম টর্চার সেল সারা বাংলাদেশজুড়ে আছে। আমার ধারণা ছিল শুধু এখানে আয়না ঘর বলতে কয়েকটা আছে। এখন শুনতেছি আয়না ঘরে বিভিন্ন ভার্সন সারাদেশজুড়ে আছে। কেউ বলে ৭শ, কেউ বলে ৮শ। সে সংখ্যাটা এখনো নিরূপণ করা যায়নি, কতটা জানা আছে, কতটা অজানা আছে। 

বন্দিশালা ঘুরে দেখে অধ্যাপক ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, বীভৎস দৃশ্য। নৃশংস জিনিস হয়েছে এখানে। 

তিনি বলেন, ‘যতটাই শুনি মনে হয়, অবিশ্বাস্য, এটা কি আমাদেরই জগৎ, আমাদের সমাজ? যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও আমাদের সমাজেই আছেন। তাদের মুখ থেকে শুনলাম। কী হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নেই।’

মানুষকে সামান্যতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘একজন বলছিলেন খুপড়ির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর থেকে তো মুরগির খাঁচাও বড় হয়। বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে।’

সমাজকে এসব থেকে বের করে না আনা গেলে সমাজ টিকবে না বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি নতুন সমাজ গড়া, অপরাধীদের বিচার করা, প্রমাণ রক্ষার ওপর জোর দেন।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ন্যায়বিচার যেন পায়, সেটা এখন প্রাধান্য। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন বাংলাদেশ ও নতুন পরিবেশ গড়তে চাই। সরকার সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন করেছে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করবে।’

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ভুক্তভোগীদের বিনা কারণে, বিনা দোষে উঠিয়ে আনা হতো। সন্ত্রাসী, জঙ্গি বলে এখানে ঢুকিয়ে রাখা হতো। তিনি বলেন, ‘এই রকম টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র) সারা দেশজুড়ে আছে। ধারণা ছিল এখানে কয়েকটা আছে। এখন শুনছি বিভিন্ন ভার্সনে (সংস্করণে) সারা দেশজুড়ে আছে। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি।’

এসময় উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রমুখ।

আয়নাঘর পরিদর্শনে মিলেছে নির্যাতন ও মানবাধিকার হরণের চিত্র

আয়নাঘর পরিদর্শনে মিলেছে নির্যাতন ও মানবাধিকার হরণের চিত্র

আয়নাঘর পরিদর্শনে মিলেছে নির্যাতন ও মানবাধিকার হরণের চিত্র। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো ভিডিও ও স্থির চিত্রে দেখা যায়, আয়নাঘরের অন্দরের চিত্র। এক একটি ফুটেজ যেন কালের সাক্ষী, বীভৎস ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। তবে আয়নাঘরের চিত্র সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠছে এর আলামত ধ্বংসের বিষয়টি। অসংখ্য গোপন কক্ষের দেয়াল ভেঙে কক্ষগুলোকে বড় করে দেখানো হয়েছে। পলেস্তারা ও রং করা হয়েছে একাধিক কক্ষের দেয়ালে। যার কারণে মুছে গেছে দেয়ালে খোদাই করা ও আঁকা বন্দিদের নানা কথা, গল্প। এ ছাড়াও টর্চার সেলের বিভিন্ন সরঞ্জামও গায়েব করা হয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলোও অকেজো করে ফেলা হয়েছে। যেসব সরঞ্জামের মাধ্যমে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো। আয়নাঘরে ছিল নির্যাতনের বিভিন্ন সরঞ্জাম। এরমধ্যে ইলেকট্রিক চেয়ার, উচ্চ শব্দ করার যন্ত্র ও বিভিন্ন ইলেকট্রিক সরঞ্জাম। কোনো কোনো কক্ষ ছিল সম্পূর্ণ সাউন্ডপ্রুফ। গোপন বন্দিশালার দেয়ালে বন্দিদের আঁকা বিভিন্ন লেখার মধ্যে ছিল- ‘আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি’, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’

এদিকে বন্দিশালাগুলো সিসি ক্যামেরা দ্বারা নজরদারি করা হতো। আজ সেসব সিসি ক্যামেরার কিছু কিছু দেখা গেলেও এসব ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে অসংখ্য কক্ষের দেয়াল। যেগুলোতে ফুটে উঠেছিল গুম হওয়া মানুষের নরকযন্ত্রণার দিনগুলোর গল্প। সেগুলোর বেশির ভাগই আজ পলেস্তার করা। যেগুলো হতো পারতো তদন্ত কমিটির কাছে এক একটি ডকুমেন্ট। প্রশ্ন উঠছে এসব আলামত ধ্বংস করা হলো কেন? কারা এসব ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছেন। আলামত ধ্বংসের জবাব কি পাওয়া যাবে? সরকারের গঠিত গুম কমিশনও বলছে অনেক আলামত ধ্বংস করা হয়েছে। কমিশনের সভাপতি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী অক্টোবরে বলেছেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স তারা নষ্ট করে দিয়েছে ওয়ালে পেইন্ট করে। ভিক্টিমরা বলেছিল ওয়ালে তাদের অনেক কথা, নাম এগুলো লেখা ছিল। অনেকের ফোন নম্বর, অনেকের ঠিকানা লেখা ছিল। ওই জিনিসগুলো পেইন্ট হওয়ার কারণে সেটা আর আমরা ওখানে পাইনি। গত ৫ই আগস্ট যখন রেজিম চেইঞ্জ হলো, তার পরপরই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের ধারণা। 

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে আলামত ধ্বংসের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আলামত ধ্বংস হয়েছে কিনা সেটি গুম কমিশন বলতে পারবে। তারা দেখছেন বিষয়টি। সে অনুযায়ী যে মামলাগুলো হয়েছে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা দেখছেন। সরকার প্রত্যেক বিষয় দেখছে। আলামত হিসেবে সবগুলো আয়নাঘর সিলগালা থাকবে। যেটি আইনি প্রক্রিয়ায় আমাদের লাগবে। আলামত ধ্বংস করা হয়েছে- আপনারা মনে করেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মনে হওয়াটা আইনি বিষয়। তারা বলবেন, আলামত ধ্বংস হয়েছে কিনা, বা কীভাবে হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আমরা পলেস্তারা দেখেছি। কোনো কোনো জায়গায় কক্ষগুলো ছোট ছিল সেখানে দেয়াল ভেঙে বড় করা হয়েছে। যেটি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত গুম কমিশন দেখবে। তিনি বলেন, দেশের কোথায় কোথায় আয়নাঘর ছিল, কারা এর সঙ্গে জড়িত- প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে। 


আয়নাঘর খুট খুটে অন্ধকার। খুপড়ি ঘর। দেখতে খুবই ছোট। অধিকাংশই তিন ফুট বাই চার ফুটের মধ্যে। যেখানে একজন বন্দির নিজের মতো করে করার কিছুই নেই। ওপরে এগজস্ট ফ্যান বা ভেন্টিলেটর জাতীয় ফ্যান লাগানো। কোনো কোনো কক্ষে দু’টি। যেখান থেকে শ্বাস নেয়ার মতো বাতাস, কিছুটা আলোও আসতো। কিন্তু এমন কক্ষের মধ্যেই বন্দির প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা। এরমধ্যেই দিনের পর দিন আটক রাখা হতো আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের। কোনো কোনো কক্ষে শুধু ছোট একটা হোলের (ছিদ্র) মতো। যেটা আবার বেশির ভাগ সময়েই লাগিয়ে রাখা হয়। বন্দি ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ওখানেই বন্দিকে প্রস্রাব-পায়খানা, গোসল করতে হতো। জায়গাটা সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট। বছরের পর বছর, মাসের পর মাস এভাবে রাখা হতো তাদের। সারাক্ষণ এগজস্ট ফ্যান চলতো খুপড়ি ঘরগুলোতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেতো। কেউ কাউকে দেখার বা কথা বলার সুযোগ নাই। হাতে হ্যান্ডকাপ ও চোখ মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। শুধু খাবার ও বাথরুমে যাওয়ার সময় এসব খুলে দেয়া হতো। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমকে নিয়ে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা টর্চার সেল বা আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্র দেখতে পেয়েছেন। আয়নাঘরের বীভৎস দৃশ্য দেখে প্রধান উপদেষ্টাও বিস্মিত হয়েছেন। বলেছেন, আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়্যামে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা (গোপন কারাগার) তার একটি নমুনা। প্রধান উপদেষ্টার অনুভূতি ব্যক্তের চেয়েও যেন ভয়াবহ চিত্র গোপন কারাগারগুলোতে, যা অধিক পরিচিতি পেয়েছে আয়নাঘর নামেই। দিনের পর দিন একেকজন বন্দি গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে বা তার সংকেত লিখে যায়, কীভাবে দিন গণনা করে, তার ধারণা মেলে গোপন কারাগারগুলোতে। বুধবার র‌্যাব-১, র‌্যাব-২ ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বাহিনী (ডিজিএফআই) এর প্রধান কার্যালয় কচুক্ষেতে গিয়ে তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ভুক্তভোগীদের কথা শুনেন। পরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও আয়নাঘর পরিদর্শনে ছিলেন বর্তমান তথ্য ও সমপ্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ ভুক্তভোগী ও সাংবাদিকরা।

আগারগাঁও র‌্যাব-২ এর আয়নাঘরের দায়িত্বে ছিল ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি)। সেখানে একটি চেয়ার দেখে যেন থমকে যান সবাই। সেই চেয়ারে বসিয়ে ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেকট্রিক শক দেয়ার বর্ণনা শোনেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যান্য উপদেষ্টা, ভুক্তভোগী ও দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা। র‌্যাব-২ এর আয়নাঘর পরিদর্শনে দেখা যায়, একটি স্টিলের চেয়ার। যেখানে ইলেট্রিক শকের সব ধরনের ব্যবস্থা। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা মতে, নির্যাতনের জন্যেই এই চেয়ার ব্যবহার করা হতো। বেশির ভাগ সময়েই ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেক্ট্রিক শক দিতে ব্যবহার হতো এই চেয়ার। ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) ছিল এই আয়নাঘরের দায়িত্বে।

পরিদর্শনে নিজেদের বন্দি জীবনের বীভৎসতার কথাও মনে পড়েছে দুই উপদেষ্টা নাহিদ ও আসিফের। তাদেরকেও ৫ই আগস্টের আগে ওই গোপন বন্দিশালায় বন্দি রাখা হয়েছিল। তারা গোপন বন্দিশালার কোনো কক্ষে ছিলেন, নিজেরাই শনাক্ত করেছেন। জুলাই মাসে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়েছিল তাদের। এরপর টর্চার সেলে (নির্যাতন কেন্দ্র) রাখা হয়। প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি আজ তার ফেসবুকে দেওয়া পৃথক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বুধবার রাজধানীর তিনটি এলাকায় গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। সুচিস্মিতা তিথি ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। একটি ছবিতে নাহিদ ইসলাম রয়েছেন। সুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআই’র এই টর্চার সেলে রাখা হয়েছিল নাহিদ ইসলামকে। সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি শনাক্ত করেন নাহিদ। এই কক্ষের একপাশে টয়লেট হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল বলে জানান তিনি। ৫ই আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়। সুচিস্মিতা তিথি ফেসবুকে আরেকটি পোস্টে অপর একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। একটি ছবিতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রয়েছেন। সুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআই’র এই টর্চারসেলে রাখা হয়েছিল আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে। পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি চিনতে পেরেছেন তিনি। দেয়ালের ওপরের অংশের খোপগুলোতে এগজস্ট ফ্যান ছিল বলে জানান তিনি।

আয়নাঘর পরিদর্শনে মিলেছে নির্যাতন ও মানবাধিকার হরণের চিত্র

আয়নাঘর নিয়ে সরব হয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা

২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন। এর পর আর খোঁজ মেলেনি সাজেদুলের। এবার আয়নাঘর নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও। তিনি বিএনপি নেতা সাজেদুলকে আয়নাঘরে কিভাবে হত্যা করা হয় তার বর্ণনা দিয়েছেন।

আজ সন্ধ্যায় তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানান, জিয়াউল আহসানের নির্দেশে সাজেদুলকে ইনজেকশন পুশ করে মেরে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়া হয়।

আয়নাঘর নিয়ে ফারুকী লেখেন, এরকমই কোনো একটা ঘরে হয়তো আমার বাল্যবন্ধু সাজেদুল ইসলাম সুমনকে আটকে রাখা হয়েছিল। এইরকমই কোনো একটা ঘরে অজানা আশঙ্কায় সে কেঁপে কেঁপে উঠতেছিল। এইরকম একটা ঘরে বসেই হয়তো সে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল- ‘আল্লাহ, তুমি আমারে এবারের জন্য বাঁচাইয়া দাও। আমি আর রাজনীতি টাজনীতি করব না। আমার সন্তানের জন্য আমারে বাঁচাইয়া দাও। আমার মায়ের জন্য আমারে বাঁচাইয়া দাও।’

ফারুকী আরও লেখেন, এরকমই একেকটা ঘরে আমরা ১৭ কোটি মানুষ আটকা ছিলাম ১৬ বছর। আর গোপনে বলতাম, আল্লাহ এই ডাইনির হাত থেকে আমাদের বাঁচাইয়া দাও।

সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা লেখেন, সুমনের সাথে আমার শেষ কথা হয় উত্তরার এক হাসপাতালে লুকাইয়া থাকা অবস্থায়। ওর ভাগনে আবরারের একটা শ্যুট ছিল আমার সাথে। স্পষ্ট মনে আছে ওর শেষ কথা, ‘দোস্ত, আবরাররে তুই ইজি কইরা নিস। নাইলে অ্যাকটিং খারাপ করব’।

তিনি আরও লেখেন, এমনই এক জালিমের শাসনে ছিলাম যে তোর জন্য, সুমন, একটা কথাও বলতে পারি নাই। পরে জানলাম মানুষরুপী জানোয়ার জিয়াউল আহসানের নির্দেশে তোরে ইনজেকশন দিয়ে মেরে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। যে বাবার ঘরে ফিরে সন্তানের সাথে ভাত খাওয়ার কথা ছিল তাকে এই ডাইনির দল শীতলক্ষ্যার মাছেদের খাবারে পরিণত করে। এই হায়েনাদের হয়ে যখন কেউ কথা বলতে আসে, আমার মাথায় রক্ত ওঠে যায়। আমি আমার কমপোজার লুজ করি।

আয়নাঘর পরিদর্শন করে যা লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক দেব

এদিকে আয়নাঘর পরিদর্শন করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক ‘ইনস্ক্রিপ্টিডটমি’-এর সম্পাদক অর্ক দেবও।

আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে অর্ক দেব সেখানকার একটি ইলেকট্রিক চেয়ারের ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘এই চেয়ারটা দেখে রাখা জরুরি। ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনার আয়নাঘরের একটি কক্ষে রাখা এই চেয়ার (আগারগাঁও অঞ্চলে)। ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেকট্রিক শক দিতে ব্যবহার হতো এই চেয়ার। ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) এই আয়নাঘরের দায়িত্বে ছিল। সারাক্ষণ একজস্ট ফ্যান চলত এই ঘরগুলোতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। আর কিছুক্ষণ। আজ থেকে গোটা বিশ্ব আয়নাঘরের সব ছবি দেখবে।’

অন্য এক পোস্টে অর্ক বলেন, এখানে বন্দি ছিলেন মাইকেল চাকমা। তিনি মাইকেল চাকমার বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘প্রথম যে দুটো রুম দেখা যাচ্ছে ঠিক এই রুমগুলোর মধ্যে ১১৩ নম্বর সেল যেটি একেবারে বাথরুমের পাশে এবং সেলের ভেতর ঢোকার সময় বাঁ সাইডের কোণায় একটি সিসি ক্যামেরা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। এই সেলে আমি প্রায় দুই বছর বন্দি ছিলাম। একই লাইনের ১১৭ নম্বর রুমে ছিলাম প্রায় দেড় বছরের একটু বেশি। নিচের রুমগুলোর মধ্যে ১০৪ নম্বর রুমে ছিলাম এক বছরের কাছাকাছি। ১০৪-এর পরে ১০৫ নম্বর সেল। এর পরে টয়লেট, বাথরুম ও চুল কাটার সেল। চুল কাটার সেল নম্বর ১০৬। এ ছাড়া আরো অনেক রুমে আমাকে রাখা হয়।’

সকালে আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগ শাসনামলকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াতের’ সঙ্গে তুলনা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গুম কমিশনকে আয়নাঘর আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আইয়ামে জাহিলিয়াত বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার এই আইয়ামে জাহিলিয়াতকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বত্র।

তিনি বলেন, এ রকম টর্চার সেল সারা বাংলাদেশজুড়ে আছে; সেগুলো শুনলাম আজকে। আমার ধারণা ছিল, এখানে আয়নাঘর বলতে যে কয়েকটা আছে তা-ই। কিন্তু এখন শুনলাম, আয়নাঘরের ভার্সন সারা দেশজুড়ে আছে। কেউ বলছে ৭০০, কেউ বলছে ৮০০। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি। কতটা জানা আছে, কতটা অজানা রয়ে গেছে।

অধ্যাপক ইউনূস জানান, গুম কমিশনের প্রতিবেদনে এ আয়নাঘরের ডকুমেন্টেশন বাধ্যতামূলক করা হবে। একইসঙ্গে যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তাদের বিচার করা হবে। এসব তথ্য-প্রমাণ সিলগালা করে রাখা হবে এবং বিচারের জন্য ব্যবহৃত হবে।

উল্লেখ্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে ‘বিশেষ’ স্থানে রাখা হতো। এ নিয়ে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এসব স্থান ‘আয়নাঘর’ নামে প্রকাশ্যে আসে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর আয়নাঘর থেকে ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। তাদের বয়ানে উঠে এসেছে আয়নাঘরের ভয়াবহতা।

আয়নাঘর নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যা লিখেছেন

আয়নাঘর নিয়ে এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ প্রতিক্রিয়া জানান।

মাহফুজ লেখেন, নৃশংস! এটাই আমাদের দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর আয়নাঘর। তিন ফুট বাই এক ফুটের সেল। দুই বিঘত জায়গায় টয়লেট। বাকি দুই ফুটে হাঁটু মুড়ে বসে থাকার জায়গা। আমার মনে হয় জুলাই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোর একটি হলো গুমের শিকার মানুষদের মুক্তি। বাংলাদেশে যেন আর কখনো গুমের মতো মানবতাবিরোধী কিছু না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।

এই উপদেষ্টা আরও লেখেন, আমরা সরকার গঠনের মাত্র ১৯ দিনের মাথায় গুম কমিশন গঠন করেছি, যারা দিনরাত কাজ করে নৃশংসতার বিবরণগুলো ডকুমেন্ট করেছেন। ২১ দিনের মাথায় আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী কনভেনশনে সই করেছি। আজকে মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখবেন হাসিনার নৃশংসতার কিছু নমুনা। আরো শ’ শ’ নমুনা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে।

তিনি লেখেন, গত ৬ মাস গুম কমিশন গুমের ভিক্টিমদের সাক্ষ্য নিয়ে, তদন্ত করে গুমের স্থান, কাল ও সত্যতা নিরূপণ করেছেন। সে সূত্রে আইসিটি ট্রাইবুনালে মামলা হয়েছে। বিচারের কাজও শুরু হয়েছে। গুমের শিকার প্রতিটা মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গণঅভ্যুত্থানের সরকারের অঙ্গীকার।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *