:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance) সনদে সাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় উপদেষ্টামণ্ডলীর সাপ্তাহিক সভায় কনভেনশনে সই করেন ড. ইউনূস। এক বিবৃতির মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
বিবৃতিতে ড. ইউনূস এই পদক্ষেপকে ‘ঐতিহাসিক উপলক্ষ্য’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনামলে অন্তর্বর্তী সরকার এই সপ্তাহের শুরুতে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা বলপূর্বক গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্তের জন্য ইতোমধ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার’।
এতে বলা হয়েছে, আমি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা, ঘোষণা করছি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কনভেনশনটি বিবেচনা করে আমরা এতে যোগদান করছি এবং তাতে অন্তর্ভুক্ত শর্তাবলি বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন ও কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছি। স্বাক্ষর করলাম, ঢাকায়, বাংলাদেশ, ২৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে, এই অ্যাক্সেশন দলিলে।
আগামী ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী দিবস, এর আগের দিন সরকার এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। কোন আপত্তি (রিজার্ভেশন) ছাড়াই সনদে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফর করতে পারেন। সেই সফরের আগে গুমবিরোধী সনদে যুক্ততার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের লক্ষ্য গুম বন্ধের পাশাপাশি এ অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া। বাংলাদেশসহ এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৬টি দেশ এ সনদে যুক্ত হয়েছে।
গুমের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষায় ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী সনদ গৃহীত হয়।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সাত শর বেশি মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১৫০ জনের বেশি মানুষের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
গুমবিরোধী সনদে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই সনদের যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটি দেখভালের জন্য জাতিসংঘের ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি কাজ করে। ওই কমিটি পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিবেদন যাচাই করে থাকে। সনদের ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সনদের পক্ষভুক্ত কোনো দেশে যদি গুমের ঘটনা ঘটে, তবে ওই দেশের পরিস্থিতি দেখার জন্য কমিটি সদস্যরা সফরও করতে পারে। যদিও পক্ষভুক্ত অনেক দেশ এই অনুচ্ছেদটির শর্ত মেনে নেয়নি।
সনদে মোট ৪৫টি অনুচ্ছেদ আছে। এতে জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্র পক্ষভুক্ত হলে সনদের ‘এক বা একাধিক অনুচ্ছেদ মেনে চলবে না’ বলেও তাদের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘকে জানাতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে; অর্থাৎ এটি তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া ভারত শুধু এটি সই করেছে এবং তবে অনুস্বাক্ষর করেনি। অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের মধ্যে শুধু ফ্রান্স এটি অনুস্বাক্ষর করেছে।
গুমবিরোধী সনদে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জেনেভায় জাতিসংঘের মিশনগুলোতে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সুফিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে পক্ষ হতে যাচ্ছে এর সঙ্গে শুধু মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়টিই জড়িত নয়। মানবাধিকারের পাশাপাশি এর সঙ্গে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক চর্চা, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মত বিষয়গুলো জড়িত। ফলে জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কিছুটা সময় নিয়ে এই সনদে পক্ষ হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সমীচিন হতো।
গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা সরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দিশালা থেকে দীর্ঘ সময় পর বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মুক্ত হয়েছেন।