এক দেশ তিন খন্ড হলো কী কারনে?

আরিফুল হক

দেশের মানুষ যদি সত্যানুসন্ধান না করে , মিথ্যা ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে চায় , সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যদি বাধাগ্রস্ত হয় , আমাদের রাজনৈতিক জীবনের ভাল মন্দ , ভুল ত্রুটি, সত্য মিথ্যা গুলোকে সামনা সামনি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে মিথ্যা এবং অপ্রয়োজনীয়গুলোকে আলাদা করে বাদ দেয়ার স্পর্ধা না দেখায় তাহলে একটা স্বাধীন সুন্দর দেশ ও সমাজ আশাকরা উচিত হবেনা ।

বহুরাজ্যে বিভক্ত ভারতকে একভারতে রুপান্তরিত করে শতশত বছর শাসন করেছিল মুসলমানরা । বৃটিশরাও দুশ বছর অখন্ড ভারত বজায় রেখেই শাসনকার্য চালিয়েছিল । বৃটিশরা দেশ ছাড়ার সময় কি এমন ঘটল যে ভারতবর্ষ প্রথমে দুখন্ড পরে তিনখন্ড হয়ে ভেঙে গেল । এ সত্য উদ্ঘাটনের সময় কি আমাদের আজও আসেনি ?

এসত্য জানার জন্য বেশি ইতিহাস ঘাঁটার প্রয়োজন পড়বেনা । ভারত ইতিহাসের দু’টি মাইলপোস্টের সামনে এসে দাঁড়ালে সবকিছু দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে যাবে । স্তম্ভ দুটি হল—

১) ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ প্রতিরোধ আন্দোলন ।

২) ১৯৪৬ সালের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের ‘ ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান বাতিল’ ।

শুনতে কটু লাগলেও বলতে হবে , দুটিই হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতাদের কারসাজির ফসল ।

১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ

বৃটিশ আমলে , বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রভিন্স নামে পরিচিত আজকের বাংলা , আসাম, পূর্ববঙ্গ , পশ্চিমবঙ্গ , বিহার , উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর নিয়ে গঠিত এই দেশ ছিল, ২লক্ষ ৪৬হাজার ৭৮৬ বর্গমাইল সীমারেখা নিয়ে বিশাল প্রভিন্স । এই বিশাল অঞ্চল জুড়ে সুষ্ঠু প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা দূরুহ অনুভূত হওয়ায় ততকালীন বৃটিশ প্রশাসন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করার চিন্তা করেন । ১৮৭৪ সালের ১২ অক্টোবর তারা প্রথম বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ১০ জেলাকে আলাদা করে আসাম প্রদেশ গঠন করেন , তখন তেমন কোন প্রতিবাদ শোনা যায় নাই ।

এই বিভাজনের পরেও বেঙ্গলপ্রেসিডেন্সির আয়তন থেকে যায় ১লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গমাইল । যা ছিল জার্মানির থেকেও বড় । এই অবস্থায় বৃটিশ সরকার বেঙ্গল প্রভিন্সকে পুনরায় ভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ।

১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গবিভাগের খসড়া তৈরি করেন । ১৯০৫ সালের জুন মাসে ভারত সচিব সেটি অনুমোদন করেন । ১৯০৫ সালের ৫ জুলাই বঙ্গবিভাগ প্রস্তাব প্রচারিত হয় । ১লাসেপ্টেম্বর প্রদেশ গঠনের সরকারি ঘোষনা দেয়া হয় এবং ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গবিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হয় ।

বঙ্গবিভাগ কেমন ভাবে করা হয়েছিল ?

অবিভক্ত বাংলার সবকটা জেলা ও দুটি দেশীয় রাজ্য নিয়ে পূর্ববঙ্গ আসাম নামক নতুন প্রদেশটি গঠিত হয় ।যেমন চট্টগ্রাম , নোয়াখালি, বাকেরগঞ্জ , ফরিদপুর, ঢাকা , মোমেনশাহী , পাবনা, বগুড়া রাজশাহী, দিনাজপুর , রংপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি , ত্রিপুরা, ও কুচবিহার ।নতুন প্রদেশের আয়তন দাঁড়ায় ১লক্ষ৬হাজার৫৪০ বর্গমাইল । এবং লোকসংখ্যা ৩কোটি ১০ লাখ । যার মধ্যে মুসলমান সংখ্যা ১কোটি ৮০লাখ ।নাম দেয়া হয় পূর্ব বঙ্গ আসাম প্রদেশ । যদিও বৃটিশ সরকার বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে আইন শৃঙ্খলা সুদৃঢ় এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন জোরদার করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভাগ করেছিলেন । কিন্তু পূর্ববঙ্গের অবহেলিত মুসলিম সম্প্রদায় ও নিম্নবর্ণ হিন্দুসম্প্রদায় এই বঙ্গবিভাগের ফলে তাদের ভাগ্যোন্নয়নের শুভ সূচনার ইঙ্গিত লক্ষ করেছিলেন ।

তারা ভেবেছিলেন নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক , শিক্ষা, অর্থনৈতিক , কৃষি , যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি হবে । ঢাকা রাজধানী হবে । চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দর হবে । কোর্ট কাচারি ঢাকতেই হবে ।নতুন নতুন রাস্তাঘাট হবে । শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে। নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে । বিশ্ববিদ্যালয় হবে ।পূর্ববাংলার শোষিত মুসলমান এবং নিম্নবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় আত্মোৎন্নয়নের এক সুখস্বপ্ন দেখতে লাগলেন ।

স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগলনা । বাদ সাধলেন বর্ণহিন্দুবাবু সম্প্রদায় । একদিকে প্রতিবাদ , অপরদিকে বিপ্লববাদের নামে সন্ত্রাসবাদ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সরল চট্টাপাধ্যায় তাঁর ‘ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমবিকাশ’ বইতে লিখেছেন -‘ বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্য সভা সমিতি সারা বাংলা দেশে অনুষ্ঠিত হয় । ১৯০৩ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯০৪ এর জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট-বড় এবং অতিবিশাল প্রায় দুহাজার বঙ্গভঙ্গবিরোধী সভায় বঙ্গের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন’। কবি রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে প্রতিবছর ১৬ অক্টোবর ‘রাখি বন্ধন দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । কালক্রমে এই সভা সমিতি সুরেন ব্যানার্জী, বারীন ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ, তিলক প্রমূখ চরমপন্থী কংগ্রেস নেতাদের উদ্যোগে ‘স্বদেশী’ নাম নিয়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের রূপপরিগ্রহ করে । এখানে বলে রাখি , এই (স্বদেশী) সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্ণ হিন্দু- সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়নি । ফলে অবর্ণশ্রেনীকে আন্দোলনে টেনে আনার জন্য বর্ণবাদী বাবুরা এক কৌশল অবলম্বন করলেন । তারা বঙ্গকে কালীমাতার রূপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’ কে জাতীয় শ্লোগানে রূপান্তরিত করলেন । এবং বর্গী তস্কর শিবাজীকে জাতীয় চেতনার প্রতীকে পরিনত করলেন রবীন্দ্রনাথ ।তিনি শিবাজী উৎসব কবিতায় লিখলেন —

“ এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে এ মহাবচন করিনু সম্বল”।

অর্থাৎ স্বদেশী আন্দোলনের নামে হিন্দু- জাতীয়তাবাদী, হিন্দু পূনর্জাগরনবাদী আন্দোলন শুরু করেদিলেন । যা ছিল ঘোর সম্প্রদায়িক এবং পূর্ববাংলার সংখ্যাগুরু মানুষের সার্থ বিরোধী ।

নতুন প্রদেশের উন্নয়নের গতিধারা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল, চাষাভুষোর ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজের সাথে পরিচিত হচ্ছিল , সেই সময় তাদের স্বপ্নসাধ গুড়িয়ে চুরমার করে দেয়া হল । ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে আগত বৃটিশ সম্রাট পঞ্চমজর্জ দিল্লী দরবার থেকে স্বয়ং বঙ্গবিভাগ রদ ঘোষনা করলেন ।

বঙ্গবিভাগ রদের ফলে সারা ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় কঠিন আঘাতে হতবিহ্বল হয়ে গেল । দিল্লী দরবার থেকে ফিরে এসে নওয়াব ওয়াকার উল মুলক আলীগড় ইনিস্টিটিউট গেজেটে এক প্রবন্ধে লিখলেন- ‘ বঙ্গবিভাগ রদ করে সরকার মুসলমানদের প্রতি অন্যায় উদাসীনতা দেখিয়েছেন । তাই আমাদের অবশ্যই বিকল্প কর্মপন্থার কথা ভাবতে হবে । মধ্যদিনের আলোকিত সূর্যের মতই এটা এখন পরিস্কার হয়ে গেছে যে, মুসলমানকে সরকারের উপর নির্ভরশীল থাকার পরামর্শ দেয়া অর্থহীন । কারো উপর ভরসা করার দিন উর্ত্তীণ ।নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করতে হবে । আমাদের গৌরবান্বিত পূর্বপুরুষগণ আমাদের জাতির জন্য সেই নজীর রেখে গেছেন’ ।

১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগ রদ করার পথ ধরে ,শুধু বাংলায় নয় , সারা ভারতে সৃষ্টি হল দুইটি জাতীয়বাদ । একটি হিন্দু , অপরটি মুসলিম জাতীয়তাবাদ ।১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হল “নিখিল ভারত মুসলিম লীগ “।

প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবিভাগের ইতিহাস বিশ্লেষন করলে আমরা যে সত্যটিকে আবিষ্কার করবো সেটা হল বঙ্গবিভাগ আন্দোলন করে হিন্দুরা চিরকালের জন্য মুসলমানকে পৃথক করে দিল ।

১৯০৬ সালে বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে মুসলমান নেতারা Separate Electorate স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি জানালেন ।অর্থাৎ কেবল হিন্দুরা হিন্দু নির্বাচন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করবে , এবং মুসলমানরা মুসলমান নির্বাচন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করবে । বড়লাট মিন্টো এই স্বতন্ত্র নির্বাচন মেনে নিলেন । বস্তুত সেদিন থেকেই ভারত বিভাগ পাকা হয়ে গেল ।

আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত মুসলমানগণ ১৯৪৭ সালের ইঙ্গ-হিন্দু শাসন শোষন থেকে মুক্তির সূর্যোদয়কে নেতিবাচক ভাবে ‘দেশ ভাগ’ বলে হাল্কা করে দেখেন । এর পেছনে মুসলমানদের দু’শ বছরের সংগ্রাম , বিপ্লব, জীবনদানের যে করুন কাহিনী যে ত্যাগ তিতিক্ষা লুকিয়ে আছে সেটা তারা ভুলেযেতে এবং ভুলিয়েদিতে চান । ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা যে ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষাকবচ ছিল, এবিষয় নিয়ে শতশত গবেষনামূলক বই লেখা হয়েছে । ইতিহাস অজ্ঞ , মূর্খরা নিজেরাতো পড়াশোনা করেইনা উপরন্তু সমগ্রজাতিকে মূর্খ ,অশিক্ষিত করে রাখার জন্য ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা নিয়ে গবেষনামূলক ইতিহাসগুলো শিক্ষাসূচীতেও অন্তর্ভুক্ত করে না ।

ভারত বিভাগের প্রেক্ষাপট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক মন্দা এবং পূর্ণস্বাধীনতার দাবীতে মুসলমান সংগঠন গুলোর ক্রমাগত চাপ,সেনা বিদ্রোহ ,নৌ বিদ্রোহ, হরতাল প্রভৃতির কারনে বৃটিশ রাজ ভারতীয় কলোনী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ।১৯৪৬সালের সেপ্টেম্বর বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লীমেন্ট এটলী ভারত ছেড়ে যাওয়ার প্ল্যান ঘোষনা করেন ।

এসময় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের আসল রূপ খোলস থেকে বেরিয়ে এল ।তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তুলে প্রচার করতে লাগলেন হিন্দুরাই জাতি এবং হিন্দুত্বই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ।হিন্দুত্বের সংজ্ঞা দিয়ে হিন্দু নেতা সাভারকর বললেন-‘ হিন্দু এমন মানুষ যিনি সিন্ধু থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতবর্ষকে নিজের পিতৃভূমি ও পূণ্যভূমি ও তার ধর্মের জন্মস্থান মনে করে । জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিপান চন্দ্র তাঁর ‘আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ’ বইতে লিখেছেন, ‘ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদ পরোক্ষভাব তার যাত্রা শুরু করে ১৮৮০ র ও ১৮৯০ এর দশকে পাঞ্জাবে এক তেজীয়ান গো-রক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে।

ভারতের মহান নেতা , অহিংসার পূজারী, জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, খিলাফত আন্দোলন বানচাল করার জন্য১৯২১ সালে বলেছিলেন-‘আমি নিজেকে একজন সনাতনী হিন্দু বলিয়া ঘোষনা করিতেছি কারন ,(১) বেদ উপনিষদ, পুরান এবং যাহা কিছু হিন্দুধর্ম বলিয়া পরিচিতি তাহার সকল কিছুতেই আমি বিশ্বাস করি। (২) বর্ণাশ্রম বর্ণে আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ় ।(৩)গোরক্ষা সম্বন্ধেও আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ় ।(৪ ) মূর্তিপূজায় ও আমি দৃঢ় বিশ্বাসী ।(গান্ধী: ইয়ং ইন্ডিয়া অক্টোবর ১২, ১৯২১ )। গান্ধীকে অনেকে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সাধক মনে করতে পারেন । কিন্তু সে ধারনা সম্পূর্ন ভূল ।গান্ধীই সেই ব্যক্তি যিনি হিন্দু মুসলিম ঘনিষ্ঠ ঐক্যে মৌলিক বিভেদ সৃষ্টি করেন । তিনি হিন্দু মুসলিম মিলনকে অপবিত্র আখ্যা দিয়ে ঘোষনা করেছিলেন – ‘(হিন্দু মুসলিম) মিলন হইত ইতর প্রকৃতির মানুষের এক দঙ্গলের হাতে ভারতবর্ষকে সমর্পন করার সমান । ভারতবর্ষের দূর্ভাগ্যের সেই পরিনতি প্রত্যক্ষ করিবার জন্য আমি ১২৫ বৎসর পর্যন্ত বাঁচিতে ইচ্ছা করিনা’।(হরিজন : ৭ এপ্রিল ১৯৪৬)।

বাংলাদেশের ১৮ কোটি মুসলমানের কত পার্সেন্ট জানে কাদের কারনে দেশভাগ হল ! কত পার্সেন্ট মানুষ জানে, কাদের কারনে অন্যায় ভাবে দেশ বিভক্ত হল । জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশভাগের কথা থাকলেও কেন পূর্ববাংলা (আজকের বাংলাদেশ) কলকাতা সহ মালদহ মুর্শিদাবাদ নিয়ে বিশাল অঞ্চল অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কথা থাকলেও কেন পেলনা । বাংলাদেশের মানুষ তারদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসই জানেনা । বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয়নি , শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে ।ভারতের মুসলমান কিংবা জিন্না সাহেব কেউই ভারত ভাগ করতে চায়নি ।ভারত ভাগের জন্য যারা দায়ী তারা হলেন হিন্দুত্ববাদী নেতা গান্ধী , নেহেরু , প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ গংদের মত সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতারা ।

অর্থাৎ ইংরেজরা ভারত ছাড়ার প্ল্যান ঘোষনার পর ভারতীয় হিন্দু নেতারা দাবি করলেন, ভারত হিন্দুদের মাতৃভূমি ,এখানে অন্য কোন জাতির অধিকার নেই ।অন্য কোন জাতি এদেশে থাকতে হলে হিন্দুজাতির অধীনস্ত হয়ে বাস করতে হবে ।

হিন্দু মহাসভা নেতা সাভারকর ঘোষনা করলেন ‘ এই উপমহাদেশের মুসলমানরা কেবল বিধর্মী নয় , তারা বহিরাগত । কেবল বৃটিশদের নয় , মুসলমানদের ও এদেশ থেকে বিতাড়িত করে গড়ে তুলতে হবে বিশুদ্ধ হিন্দুরাষ্ট্র ‘।

আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত মুসলমানগণ ১৯৪৭ সালের ইঙ্গ-হিন্দু শাসন শোষন থেকে মুক্তির সূর্যোদয়কে নেতিবাচক ভাবে ‘দেশ ভাগ’ বলে হাল্কা করে দেখেন । এর পেছনে মুসলমানদের দু’শ বছরের সংগ্রাম , বিপ্লব, জীবনদানের যে করুন কাহিনী যে ত্যাগ তিতিক্ষা লুকিয়ে আছে সেটা তারা ভুলেযেতে এবং ভুলিয়েদিতে চান । ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা যে ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষাকবচ ছিল, এবিষয় নিয়ে শতশত গবেষনামূলক বই লেখা হয়েছে । ইতিহাস অজ্ঞ , মূর্খরা নিজেরাতো পড়াশোনা করেইনা উপরন্তু সমগ্রজাতিকে মূর্খ ,অশিক্ষিত করে রাখার জন্য ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা নিয়ে গবেষনামূলক ইতিহাসগুলো শিক্ষাসূচীতেও অন্তর্ভুক্ত করে না ।

বাংলাদেশের ১৮ কোটি মুসলমানের কত পার্সেন্ট জানে কাদের কারনে দেশভাগ হল ! কত পার্সেন্ট মানুষ জানে, কাদের কারনে অন্যায় ভাবে দেশ বিভক্ত হল । জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশভাগের কথা থাকলেও কেন পূর্ববাংলা (আজকের বাংলাদেশ) কলকাতা সহ মালদহ মুর্শিদাবাদ নিয়ে বিশাল অঞ্চল অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কথা থাকলেও কেন পেলনা । বাংলাদেশের মানুষ তারদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসই জানেনা । বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয়নি , শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে ।

ভারতের মুসলমান কিংবা জিন্না সাহেব কেউই ভারত ভাগ করতে চায়নি ।ভারত ভাগের জন্য যারা দায়ী তারা হলেন হিন্দুত্ববাদী নেতা গান্ধী , নেহেরু , প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ গংদের মত সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতারা ।

কেবিনেট মিশন প্ল্যান (লর্ড ওয়াভেল প্ল্যান)

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লীমেন্ট এটলী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা তরান্বিত করার জন্য ভারতে নিযুক্ত ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল কে নির্দেশ দিলেন এবং ভাইসরয়কে সাহায্য করার জন্য লন্ডনের ভারত সচিব লর্ড প্যাথিক লরেন্স, ব্যনিজ্য বোর্ডের সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস ও নৌবহরের সচিব এ ভি আলেকজান্ডারের সমন্বয়ে এক কমিশন গঠন করে দিলেন । যারা গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংবিধান রচনার মাধ্যমে , হিন্দু মুসলমানের স্বার্থ অটুট রেখে অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার এক ফর্মূলা নির্ধারণ করেদিলেন , যার নাম ছিল ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ।

ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক নির্বাচন প্রথায় প্রতি দশ লাখ ভোটার থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে একটা ক্রেন্দ্রীয় সংবিধান সভা রচিত হবে, এবং সেই সংবিধান সভাই ভারত ইউনিয়নের জন্য সংবিধান রচনা করবে । বৃটিশ ভারতে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য গ্রুপিং ব্যবস্থায় ভারতকে এ বি সি তিনটি গ্রুপে ভাগকরার প্রস্তাব রাখা হল । বলা হল , বোম্বে, মাদ্রাজ, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ, উড়িষ্যা, অর্থাৎ সবগুলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা নিয়ে হবে ‘গ্রুপ এ’।

পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, সিন্ধু এবং পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে হবে ‘গ্রুপ বি’।

বাংলা আসাম অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে গঠিত হবে ‘গ্রুপ সি’। এবং এই তিনগ্রুপ মিলে হবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র । আরও প্রস্তাব করা হল , প্রতেকটি গ্রুপের নিজস্ব সংবিধান রচনা করার অধিকার থাকবে । দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র , ও যোগাযোগ এই তিনটে বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রনে রেখে, বাকি সব বিষয়ের উপর গ্রুপগুলোর নিজস্ব কর্তৃত্ব থাকবে ।

জিন্না সাহেব ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান মেনে নিলেন । কংগ্রেস সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও ক্যাবিনেটমিশন প্ল্যান হুবহু মেনে নিলেন । জনগণ ভাবলো ভারতের স্বাধীনতার পথে আর কোন বাধা রইলনা । কিন্তু মিঃ গান্ধী এ নিয়ে নিরব ভুমিকা পালন করলেন ।

তিনদিন পর কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে গান্ধীর চক্রান্তে আবুল কালাম আজাদ কে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে জওহরলাল নেহেরুকে সভাপতি নির্বাচন করা হল ।নেহেরু ১লা জুলাই বোম্বেতে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষনা করলেন কংগ্রেস গ্রুপ সরকার ব্যবস্থা আপাতত মেনে নিলেও ভবিষ্যতে ভারত সরকারের উপর চাপিয়ে দেওয়া কোন শাসনতান্ত্রিক বিধান ভারতীয় গণপরিষদ বা কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট মানতে বাধ্য থাকবেনা । তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর ভোটেই সবকিছু ঠিক করবে । অপরদিকে আসামের মূখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলুই , গান্ধীর ইঙ্গিতে আসাম বাংলার সাথে গ্রুপভুক্ত থাকবেনা বলে বিবৃতি দিয়ে আন্দোলন শুরু করে দিলেন ।

জিন্নাহ সাহেব কংগ্রেসের এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আচরনে খুব হতাশ হলেন ।তিনি বললেন ‘ইংরেজ সরকার থাকাকালীন অবস্থায় কংগ্রেস নেতারা যখন ইচ্ছামত কথা পাল্টাচ্ছেন তখন ইংরেজরা চলেগেলে এরা কি করবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই ‘। অতএব ভারত বিভাগ ছাড়া শান্তির আর কোন পথ নেই । ১৯৪৬ সালের ২৭ জুলাই মুসলিমলীগ কাউন্সিল সভায় ১৬ আগষ্ট ১৯৪৬ সভা মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে ‘ডাইরেক্টএ্যাকশন ডে’ পালনের কর্মসূচী ঘোষনা করা হল ।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট কলকাতার গড়ের মাঠে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে উপলক্ষে এক বিশাল জণসভা হয়েছিল । সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য বশঃত বর্তমান প্রতিবেদক উক্ত জণসভায় উপস্থিত ছিলেন । সেদিন ছিল দেশব্যপী হরতাল ।চাঁদতারা পতাকা, ফেস্টুন, আর মিছিলে ভরে গিয়েছিল কলকাতার রাস্তাঘাট ।সেই জণসভায় খ্রিস্টান সম্প্রদায় , তপসিলি ও আদিবাসীরাও যোগ দিয়েছিলেন । সভাপতটি করেছিল সোহরাওয়ার্দি সাহেব ।অনেকে বক্তৃতা করেছিলেন । তাঁদের মধ্যে ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন ও লাহোরের রাজা গজনফর আলি খান ।

এদিকে কলকাতার হিন্দু প্রধান এলাকার অলিগলিতে মুসলমান নিধনের জন্য যে গোপন অস্ত্রসজ্জা চলছিল সেকথা মুসলমানরা আন্দাজ করতেই পারেনি । সভা ফেরত মুসলমানদের যেখানেই পেয়েছে হিন্দুরা তাদের হত্যা করেছে । শত শত মুসলমানের লাশে ভরে উঠেছিল ধর্মতলা থেকে ওয়েলিংটন স্ট্রিট হয়ে শ্যামবাজারে ফুটপাত । সেই দাঙ্গা ৫দিন স্থায়ী ছিল ।১০হাজারের মত নরনারী, বৃদ্ধ শিশু নিহত হয়েছিল। ১৫ হাজারের মত মানুষ আহত হয়েছিল । মুসলমানদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছিল।ধর্ষন এবং লুন্ঠনের ভয়ে হিন্দু অঞ্চলে বসবাসকারি মুসলমানরা বাড়ীঘর ফেলে এক কাপড়ে মুসলমান প্রধান অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে প্রান বাঁচাতে বাধ্য হয়েছিল । ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্টের মুসলনমান হত্যা বলেদিয়েছিল ভারতের হিন্দু মুসলমান আর একসাথে থাকতে পারবেনা , অতএব দেশ বিভাগ অপরিহার্য । কিন্তু দায়ী কে ?

পরের ইতিহাসও মুসলমান বিদ্বেষে ভরপুর । নেহেরু , কৃষ্ণমেনন পমূখ হিন্দু নেতাদের আবদারে ক্লীমেন্ট এটলী নেহেরুর পছন্দের মানুষ রাজার কাজিন, লর্ডমাউন্টব্যাটেন কে ভাইসরয় করে দায়ীত্ব দিয়ে পাঠালেন । সঙ্গে জুড়ে দিলে আইনজীবী সিরিল- রাডক্লিফ কে , যিনি এর আগে ভারতে কোন দিন পা রাখেনি ।সারাভারতে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দাবালন জ্বলছে । দাম্ভিক মাউন্টব্যাটন তারই ভিতর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত জানালেন । মাউন্টব্যাটনের পোষাচাটুকার রাডক্লিফ মাত্র ৫ সপ্তাহের মধ্যে(৮জুলাই ১৬ আগষ্ট গমন) বিরাট ভারতের শতশতমাইল এলাকা আর কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য এক টেবিলে বসেই নির্নয় করে দিলেন ।রাডক্লিফ তার সীমান্ত রোয়েদাদ সমাপ্ত করে মাউন্টব্যাটনের হাতে জমা দেন , এবং অনুরোধ করেন ১৫ আগস্টের আগেই ঘোষনা করার জন্য , কিন্তু তা করা হয়নি । কেন বৃটিশ শাসন শেষ হবার দিনেই তা ঘোষনা করা হল সেটাও রহস্যে ঘেরা । বিশেষজ্ঞরা একমত যে এই ৯-১৫ তারিখের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে । অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । কারন ৮ তারিখ চুড়ান্তকৃত মানচিত্র এবং ১৫ তারিখ ঘোষনাকৃত মানচিত্রে নানা রকম রদবদল করা হয়েছে ।ঐতিহাসিক রা আবিষ্কার করেন যে নেহেরুর অনুরোধে মাউন্টব্যটন রাডক্লিফকে চাপ দিয়ে ভারতের স্বার্থ অনুযায়ী সীমান্ত রদবদল করান হয় । যার ফলে কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ,মালদা, বালুরঘাট , সিলেটের কাছাড় করিমগঞ্জ, শিলচর , হাইলাকান্দির মত বিস্তীর্ণ এলাকা পাকিস্তানের হাতছাড়া হয়ে যায় ।

বৃটিশ ও ভারতীয় মৌলবাদীদের পক্ষথেকে সৃষ্ট বহুবিধ সমস্যা , বিঘ্ন, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেও পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল, স্বাধীনই শুধু হয়নি অল্প কয়েক বছরে ভারতের চাপিয়ে দেয়া ৩-৪টি যুদ্ধ হামলা মোকাবিলা করেও মজবুত অর্থনীতি নিয়ে দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।

বাংলাদেশ মীরজাফরের দেশ ইতিহাস একথা বারবার প্রমান করেছে । আমরা ইতিহাসকে অবজ্ঞাকরে অন্ধকারের গোলকে ঘুরপাক খাচ্ছি ।

লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *