স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের নতুন বয়ান

:: মিজানুর রহমান জামি ::

বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের যে নতুন বয়ান প্রচলন করা হয়েছে সেখানে এই ভুখন্ডের মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ইতিহাসের যে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছিলো সেটাকে ‘নাই’ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাত আদিকাল থেকে বর্তমান বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে আড়াল করে মূল ফোকাসটা করা হয়েছে কীভাবে একটি অখণ্ড ভারতীয় সত্তা থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে (এ বিষয়ে প্রথম কমেন্টে দেওয়া লিঙ্ক দেখা যেতে পারে)। ইতিহাস বর্ণনার এই ধারাকে বলা যায় বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ‘ভারতীয়করণ’ হিসেবে। তাত্ত্বিকভাবে এটা দামোদর সাভারকারের ‘অখন্ড ভারত’ বা ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস’ ঘরানাকে ফলো করে। এই ধারায়- বাংলাদেশ ও তার প্রাচীন ইতিহাস ফোকাসে নাই।কখনো এটার কেন্দ্র ছিলো মগধ কিংবা কখনো দিল্লী। তবে ইতিহাসের নানাপর্বে প্রাচীন বাংলাদেশের মানুষ উত্তর ভারতীয় শাসকদের নিকট থেকে নিজেদের স্বাধীন সত্ত্বাকে আলাদা রাখতে সমর্থ হয়েছিলো বলে নানা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে জানা যায়। সম্ভবত, এ এলাকার নিচু-জলাভূমি, অসংখ্য নদীনালা, উঞ্চ ও আদ্র‍ জলবায়ু , বৃষ্টিপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক সুরক্ষা হিসেবে কাজ করেছিলো যে কারনে এখানে বর্হিআক্রমণ কিংবা উত্তর ভারতীয় শাসকদের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্খাতে বাধ সেধেছিলো।

প্রাচীনকাল থেকে এরকম একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্তরাধিকারী একটি ভুখন্ডকে (বর্তমান বাংলাদেশ) কেন স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ‘ভারতীয়করণ’ করা হলো তা অস্পষ্ট। ভারতের প্রগতিশীল ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবিগণও এ ধরনের ইতিহাসের বিরোধিতা করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের ইতিহাস বইতেও এরকম ন্যারেটিভ দেখলাম না। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যিনি এই ইতিহাস লিখেছেন তিনি তার বিশ্বাস অনুযায়ী প্রবন্ধ আকারে যে কোন জার্নালে এটা ছাপাতে পারেন। কিন্তু স্কুল পাঠ্যপুস্তকে কেন?

২.

প্রাচীন ভারতে প্রথম সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিলো চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাত ধরে ৩২২ খৃ.পূর্বাব্দে, মৌর্য সাম্রাজ্য নামে। তারও আগে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার ৩২৬/২৭ খৃ.পূর্বাব্দে সেই সময়ের ভারতে (তখন ভারত নামে কোনো দেশ ছিলো বলে জানা যায় না, তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত নানা রাজ্য ছিলো এগুলোকে বলা হতো জনপদ বা রাজ্য) আক্রমণ করেছিলেন এবং তিনি বিজিত বিভিন্ন এলাকায় গ্রীকদের মধ্য থেকে প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। সেই সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ/পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে অত্যন্ত শক্তিশালী ‘গঙ্গারিডাই’ নামে একটি জাতি বাস করতো যাদের বসবাসের এলাকা হিসেবে ইতোপূর্বে কেউ কেউ চন্দ্রকেতুগড়ের কথা বললেও অধুনা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত আলামতের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে এই জায়গাটি সম্ভবত ছিলো নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর ও সংলগ্ন অঞ্চল (দেখুন- রহমান, সুফি মোস্তাফিজুর ও পাঠান, হাবিবুল্লা, ২০১২, উয়ারী-বটেশ্বর শিকড়ের সন্ধানে, প্রথমা, ঢাকা।; Hossain, M.M. 2022. Military History of ancient Bengal a study of the fortification at Wari-Bateshwar, Aryan Publication, Delhi, India.)। এ ছাড়াও উয়ারী-বটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা এ এলাকায় একটি স্বাধীন জনপদ/রাজ্য থাকার স্বাক্ষ্য বহন করে, উত্তর ভারতে মৌর্য্য সাম্রাজ্য গড়ে ওঠারও আগে।

তারও আগে খ্রি.পূর্ব ৫০০ অব্দ থেকেই এ অঞ্চলে মানুষের বসতি ছিলো যারা ছিলো এ এলাকার আদিম অধিবাসী। এই মানুষেরা ছিলো কৃষিজীবি, যারা একটি স্বতন্ত্র কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলো বিশেষত ‘শুষ্ক ধান ও মিলেট (কাউন/চিনা)’ চাষাবাদের মাধ্যমে। এই স্বতন্ত্র কৃষি উতপাদনের ধারাবাহিকতাতেই কালের পরিক্রমায় বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে একটি স্বাধীন জনপদ/রাজ্য গড়ে উঠেছিলো বলে প্রত্নতাত্বিক ও প্রত্নউদ্ভিজ স্বাক্ষ্যে প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্ভবত এই রাজ্যের নাম ছিলো ‘লৌহিত্য’। খুব সম্ভবত, পাঠ্যপুস্তকে এই ইতিহাসসমূহ যা এই এলাকার ইতিহাসের স্বতন্ত্র রুপ তুলে ধরে তা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট ‘টার্গেট’ হাসিলের নিমিত্বে।

পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের এই বয়ান সরল চোখে অধিকাংশ মানুষের চোখে পড়বে না। এটা বুঝতে হলে আপনাকে দুটো বিষয়ে ধারণা রাখতে হবে। ১. সাভারকারের দেয়া ‘ইতিহাসতত্ত্ব’ যা ‘অখন্ড ভারত’ বা ‘হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসতত্ত্ব’ নামেও পরিচিত। ২. প্রাচীন বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাসের মৌলিক জ্ঞান। তবে কেউ বুঝুক আর না বুঝুক শিশু শিক্ষার্থীদের মগজে এই বয়ান গভীরভাবে বসে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

৩.

বর্তমান বাংলাদেশের ভেতরে, মহাস্থানগড় কিছুকালের জন্য সম্ভবত মৌর্য শাসকদের শাসনাধীনে এসেছিলো। একটি লিপি স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে এই অনুমান করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লস এঞ্জেলস এর প্রফেসর মনিকা এল স্মিথ ও অন্যন্য, মৌর্য সম্রাট অশোকের ‘পাথর লিপি’ ও ‘স্তম্ভ লিপি’র প্রাপ্তিস্থানের উপরে ভিত্তি করে দেখিয়েছেন যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের এ সকল আলামত/নিদর্শন বর্তমানের উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে ছিলো না বরং পশ্চিমে গান্ধার (কান্দাহার, আফগানিস্থান) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো (Smith, et al. 2016. Finding history: the locational geography of Ashokan inscriptions in the Indian subcontinent, ANTIQUITY 90 (350): 376–39।) পরবর্তীকালে গুপ্ত ও পরবর্তী গুপ্ত শাসনামলের কিছু ভুমিদানপত্র ও মুদ্রা বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া গেলেও সে সময়ের বসতি, কিংবা গুপ্ত সময়ে উত্তরভারতে যে ধরনের অবকাঠামো তৈরি হয়েছিলো তা এ এলাকায় পাওয়া যায় না। তারও পরে শশাঙ্ক, পাল ও সেন শাসকগণ যে রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন তার কেন্দ্র ছিলো বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। তারও পরে ত্রয়োদশ শতক থেকে মুসলমানদের আগমনের ধারাবাহিকতায় যে নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছিলো তা কখনো কখনো দিল্লী সালতানাতের অধীনে গেলেও অধিকাংশ সময় স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলো। মোগলদের সময়েও সুবা বাংলা অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করতো যে কারনে এই সময়কে অনেকে নবাবী আমলও বলে থাকেন। আনু. খৃষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ হতে ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে স্বাধীনতা হারানোর পূর্ব পর্যন্ত যে প্রাচীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা তার অধিকাংশ জুড়েই ছিলো স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জল। কখনো একক শাসনাধীনে আবার কখনো নানা জনপদে/রাজ্যে বিভক্ত থাকলেও সার্বিকভাবে এই এলাকা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিলো। তবে বর্তমানের ভারতীয় ভুখন্ডের নানা রাজ্য, বিশেষত মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষের সাথে এক ধরনের বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিলো তা প্রত্নতাত্ত্বিক আলামতে স্পষ্ট। এই ধরনের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রাচীন বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তিব্বত ও চীনের সাথেও ছিলো বলে প্রত্নতাত্বিক ও প্রত্নউদ্ভিজ্জ স্বাক্ষ্যে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

৪.

প্রাচীনকাল থেকে এরকম একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্তরাধিকারী একটি ভুখন্ডকে (বর্তমান বাংলাদেশ) কেন স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ‘ভারতীয়করণ’ করা হলো তা অস্পষ্ট। ভারতের প্রগতিশীল ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবিগণও এ ধরনের ইতিহাসের বিরোধিতা করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের ইতিহাস বইতেও এরকম ন্যারেটিভ দেখলাম না। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যিনি এই ইতিহাস লিখেছেন তিনি তার বিশ্বাস অনুযায়ী প্রবন্ধ আকারে যে কোন জার্নালে এটা ছাপাতে পারেন। কিন্তু স্কুল পাঠ্যপুস্তকে কেন?

৫.

পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের এই বয়ান সরল চোখে অধিকাংশ মানুষের চোখে পড়বে না। এটা বুঝতে হলে আপনাকে দুটো বিষয়ে ধারণা রাখতে হবে। ১. সাভারকারের দেয়া ‘ইতিহাসতত্ত্ব’ যা ‘অখন্ড ভারত’ বা ‘হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসতত্ত্ব’ নামেও পরিচিত। ২. প্রাচীন বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাসের মৌলিক জ্ঞান। তবে কেউ বুঝুক আর না বুঝুক শিশু শিক্ষার্থীদের মগজে এই বয়ান গভীরভাবে বসে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

৬.

একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে আমার কাজ সত্যকে উন্মোচন করা। এ্টা অব্যাহত থাকবে। আশা করি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।

অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য থেকে

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *