ইসরায়েল থেকে মুক্তি পেল ৩ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ৩ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। সোমবার এই কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

দু’টি ব্যাচে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এই কারাবন্দিদের। প্রথম ব্যাচটি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর অঞ্চলের রাজধানী রামাল্লার পশ্চিমাংশে ইসরায়েলের মালিকানাধীন ওফার কারাগারের। এই ব্যাচে কারবন্দিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার।

গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে সোমবার স্থানীয় সময় দুপরের ‍দিকে বেশ কয়েকটি বাসে চেপে ওফের কারাগার থেকে পশ্চিম তীরের বেইতুনিয়া শহরে এসে পৌঁছেছেন এই কারাবন্দিরা। কারাবন্দিদের জন্য বাস সরবরাহ করেছে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইসিআরসি)।

এদিকে প্রথম ব্যাচটি পশ্চিম তীরে যাওয়ার কাছকাছি সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার খান ইউনিস শহরে এসে পৌঁছান দ্বিতীয় ব্যাচের ১ হাজার ৭১৮ ফিলিস্তিনি কারাবন্দি।  দক্ষিণ ইসরায়েলের নাগেভ কারাগারে ছিলেন তারা।

‘আমরা কসাইখানায় ছিলাম, কোনো কারাগারে না। দুর্ভাগ্যবশতা আমরা ‘ওফার কারাগার’ নামে এক কসাইখানায় ছিলাম। অনেক তরুণ এখনো সেখানে বন্দি।’

এমনটাই বলেন সোমবার (১৩ অক্টোবর) ইসরায়েলি কারগার থেকে মুক্তি পাওয়া  আব্দাল্লাহ আবু রাফে নামের এক ব্যক্তি।

তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলি করাগারগুলোর অবস্থা  অত্যন্ত ভয়াবহ। সেখানে কোনো গদি নেই, যা ছিল তারা সেগুলোও কেড়ে নিয়েছে।  খাবারের অবস্থাও শোচনীয়।  সব কিছুই সেখানে খুব কঠিন।’

মুক্তির অনুভূতি নিয়ে রাফে বলেন, ‘অসাধারণ এক অনুভূতি।’

মুক্তি পাওয়া আরেক ফিলিস্তিনি ইয়াসিন আবু আমরা ইসরায়েলি কারাগারের অবস্থা ‘অত্যন্ত, অত্যন্ত খারাপ’ বলে বর্ণনা করেন। 

তিনি বলেন, ‘খাবার, নির্যাতন, মারধর—সবকিছুই ভয়াবহ ছিল। কোনো খাবার বা পানি ছিল না। আমি টানা চার দিন কিছু খাইনি। এখানে আমাকে দুটি মিষ্টি দেওয়া হয়েছে, আমি সেগুলো খেয়েছি।’

সোমবার মুক্তি পাওয়া আরেকজন বন্দি সাঈদ শুবাইর জানান, তিনি তার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না। 

তার ভাষায়, ‘এই অনুভূতি বর্ণনাতীত।  কারাবন্দি না হয়ে সূর্য দেখা—এ এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। আমার হাত এখন শৃঙ্খলমুক্ত। স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই—এটি অমূল্য।’

ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় কারা দপ্তরের বিবৃতিতে নাগেভ-এর কারাবন্দিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর সেখান থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে থেকে ১ হাজার ৭১৮ জনকে মুক্তি দেওয়া হলো। এই কয়েদিদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন।

গাজায় যেসব কারাবন্দি এসে পৌঁছেছেন, তাদের সবাইকে প্রাথমিক মেডিকেল পরীক্ষা করেছে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসের নাসার মেডিকেল কমপ্লেক্স।

কারাবন্দিদের স্বাগত জানাতে পশ্চিম তীরের বেইতুনিয়া ও গাজার খান ইউনিসে জড়ো হয়েছিলেন শত শত ফিলিস্তিনি।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় প্রায় ১ হাজার হামাস যোদ্ধা। এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় যোদ্ধারা। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েলের ইতিহাসে ৭ অক্টোবরের হামলা ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।

হামাসের হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের উদ্ধারে পরদিন ৮ অক্টোবর থেকেই গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ভয়াবহ সেই সামরিক অভিযানে ২ বছরে গাজায় নিহত হয়েছেন ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার।

গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার এই যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা চলেছে। সেসব চেষ্টার অংশ হিসেবে কয়েক দফা অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিও ঘোষণা করে ইসরায়েল। সেসব যুদ্ধবিরতির সময় বেশ কিছু জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। বিনিময়ে ইসরায়েলও কারাগার থেকে কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন জিম্মি আটক ছিল হামাসের হাতে। তবে গোষ্ঠীটি আগেই জানিয়েছিল, কাগজে-কলমে ৪০ জন থাকলেও এই জিম্মিদের মধ্যে বর্তমানে জীবিত আছেন ২০ জন।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য নতুন একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব আকারে পেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েল ও হামাস উভয়ে সেই পরিকল্পনায় সম্মতি জানানোর পর গত শুক্রবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয় গাজায়।

যুদ্ধবিরতির তৃতীয় দিন সোমাবার অবশিষ্ট ২০ ইসরায়েলি জিম্মির সবাইকে মুক্তি দেয় হামাস। এই জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়েই ৩ হাজার ৭ শতাধিক ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিলো ইসরায়েল।

মুক্তি পাওয়া এসব কয়েদিদের মধ্যে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামি নেই। ইসরায়েল আগেই জানিয়েছিল, মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত কোনো ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হবে না।

ইসরায়েল থেকে মুক্তি পেয়েও নির্বাসনে ১৫৪ জন

ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দিদের জন্য এই মুক্তি মিশ্র অনুভূতির কারণ হয়েছে। কারণ, তাদের পরিবারের সদস্যরা জানতে পেরেছেন, তাদের প্রিয়জনদের তৃতীয় কোনো দেশে জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানো হবে। 

কোথায় এই মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিদের পাঠানো হবে, তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আগের এক বন্দিমুক্তি চুক্তিতে ইসরায়েল ডজনখানেক বন্দিকে তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও তুরস্কসহ অঞ্চলের কয়েকটি দেশে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই জোরপূর্বক নির্বাসন আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং এতে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের নাগরিকত্বের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তারা এটিকে বন্দিবিনিময়ের ক্ষেত্রে দ্বৈত মানদণ্ডের উদাহরণ বলেও উল্লেখ করেছেন। 

দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের জননীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তামের কারমাউত আল জাজিরাকে বলেন, ‘এটা যে অবৈধ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, এরা ফিলিস্তিনের নাগরিক। তাদের ছোট এক কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও এখন তাদের বড় এক কারাগারে পাঠানো হচ্ছে—নিজেদের সমাজ থেকে দূরে, এমন এক দেশে যেখানে তাদের ওপর নানা বিধিনিষেধ থাকবে। এটা অমানবিক।’

অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনি বন্দি মুহাম্মদ ইমরানের পরিবারের সদস্যরা আল জাজিরাকে জানান, মুহাম্মদকে নির্বাসনে পাঠানোর খবর শুনে তারা হতবাক হয়েছেন। তার ভাই রায়েদ ইমরান জানান, ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আগে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, ৪৩ বছর বয়সী মুহাম্মদকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু পরিবারটি সোমবার জানতে পারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রেফতার হওয়া এবং ১৩টি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মুহাম্মদকে দেশে ফেরানো হচ্ছে না, বরং নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। 

আল–জাজিরার প্রতিবেদক নিদা ইব্রাহিম বলেন, ‘অনেক পরিবার হয়তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, যেখানে তাদের প্রিয়জনদের ফিলিস্তিনের বাইরে নির্বাসনে পাঠানো হবে, কিন্তু নিজেরা সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ থাকবে না,’ কারণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। জাতিসংঘের হিসেবে, গাজা থেকে যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের অনেকেই ‘জোরপূর্বক গুমের শিকার’ হয়েছেন।

চার ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ ফেরত দিয়েছে হামাস

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির পাশাপাশি এখন পর্যন্ত চারজনের মরদেহ ফেরত দিয়েছে হামাস। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এবং হামাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

খবরে বলা হয়েছে, গাজা থেকে হামাসের কাছে থাকা চার নিহত জিম্মির মরদেহ সংবলিত কফিন ইসরায়েল গ্রহণ করেছে। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে, হামাস অস্ত্রবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। কারণ, তারা প্রতিশ্রুত সব মরদেহ ফেরত দেয়নি। হামাস বাকি ২৪ জন নিহত বন্দীর ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জানায়নি।

হামাস জানিয়েছে, গতকাল সোমবার তারা গাই ইলোজ, ইয়োসি শারাবি, বিপিন জোশি ও ড্যানিয়েল পেরেজের মরদেহ ফেরত দিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় গাজা উপত্যকায় তাদের সেনারা রেডক্রসের মাধ্যমে চারটি কফিন পেয়েছে, যাতে নিহত বন্দীদের মরদেহ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েলি পুলিশ কফিনগুলো তেল আবিবের আবু কাবির ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেছে, যেখানে মরদেহগুলো শনাক্ত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

ইসরায়েলের অভিযোগ, হামাস অতীতেও কয়েকবার প্রকৃত বন্দীর বদলে অন্য ব্যক্তির মরদেহ ফেরত দিয়েছে। বিপিন জোশির মৃত্যু ইসরায়েল আগে নিশ্চিত করেনি, তবে তাঁর অবস্থা নিয়ে কর্তৃপক্ষ ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছিল।

ইসরায়েলের চ্যানেল-১২-এর খবরে বলা হয়েছে, সোমবার দ্বিতীয় এক বন্দী তামির নিমরোদির পরিবারকে জানানো হয়, তিনিও মারা গেছেন। তবে এটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়নি। ‘হোস্টেজ ফ্যামিলিস ফোরাম’ জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি। কয়েক দিন ধরে ধারণা করা হচ্ছিল যে নিমরোদি ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, তাঁরা ২০ জীবিত ও ২৮ নিহত বন্দীর মরদেহ ফেরত পাওয়ার আশা করছেন।

সোমবার এর আগেই হামাস তাদের হাতে থাকা শেষ ২০ জীবিত বন্দীকে ফেরত দেয়। এটি গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা আংশিক প্রত্যাহারের পর এবং উপত্যকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঘটেছে।

বিপিন জোশি নেপাল থেকে ইসরায়েলে যাওয়া কৃষি শিক্ষার্থী ছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত না হলেও ইসরায়েল তাঁর অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছিল। গাই ইলোজ নোভা সংগীত উৎসব থেকে অপহৃত হন এবং পরে গাজার এক হাসপাতালে মারা যান। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

ড্যানিয়েল পেরেজ (২২) ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ৭৭তম ব্যাটালিয়নের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। তিনি ইয়াদ বেনিয়ামিন শহরের বাসিন্দা এবং গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। ইয়োসি শারাবি (৫৩) মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দী এলি শারাবির ভাই। তিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর কিব্বুতজ বেইরি থেকে অপহৃত হন এবং পরে বন্দিদশায় নিহত হন।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মরদেহ শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই দিন লাগতে পারে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *