ডা. মৌমিতাকে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে উত্তাল ভারত

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে কতর্ব্যরত অবস্থায় ডা. মৌমিতা দেবনাথকে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা ভারত। মৌমিতা (৩০)-কে গত ৯ আগস্ট ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) রাতে টানা ৩৬ ঘণ্টার ‘অন-কল’ ডিউটিতে ছিলেন তরুণী চিকিৎসক। রাতে অলিম্পিকে জ্যাভলিন থ্রোর ফাইনালে ভারতের নীরজ চোপড়ার ইভেন্ট টিভিতে দেখে এবং অনলাইনে আনানো খাবার সহকর্মীদের সঙ্গে খেয়ে চারতলার পালমোনোলজি বিভাগের সেমিনার হলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে যান তিনি।

পরদিন সকালে জুনিয়র সহকর্মীরা ওই হলের ভেতরেই তার অর্ধনগ্ন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। নিহত তরুণীর গোপনাঙ্গের পাশেই পড়ে ছিল মেয়েদের মাথার চুলের একটি ক্লিপ।

আন্দোলনকারীরা আরও জানাচ্ছেন, নিহত ওই তরুণীর পোস্টমর্টেম ও অটোপসি রিপোর্টের কপি তাদের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তার স্টার্নাম, কলারবোনও পেলভিক জয়েন্ট ভেঙে গিয়েছিল। চোখ, মুখ ও যৌনাঙ্গ থেকে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল।

তরুণীর বাম পায়ে, ডান হাতে, ডান হাতের আঙুলে, ঘাড়ে ও ঠোঁটে মোট ১১টি ক্ষত ছিল। সারা শরীরে নির্যাতনের যে ধরনের লক্ষণ পাওয়া গেছে তা থেকেই তার সহকর্মীরা মনে করছেন, এই কাজ কিছুতেই একজন ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়।

শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন সঞ্জয় নামে এক নিরাপত্তাকর্মী।

এ ঘটনায় গত কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন। পথে নেমেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরাও। এতে এক প্রকার ভেঙে পড়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা। আন্দোলনের মুখে পড়ে পদত্যাগ করেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ।

আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, পুলিশের হাতে আটক সঞ্জয়ের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত আছে। ধৃত সঞ্জয় রায় ২০১৯ সালে কলকাতা পুলিশের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। পরে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি বদলি নেন কলকাতা পুলিশের ‘ওয়েলফেয়ার সেল’ বা কল্যাণ সমিতিতে, যার সুবাদে আর জি কর হাসপাতাল কমপ্লেক্সে তার অবাধ যাতায়াত ছিল।

এমনকি, পুলিশ বাহিনীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ওই ব্যক্তি থাকতেন কলকাতা পুলিশের ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের চত্বরেই। চলাফেরা করতেন কলকাতা পুলিশের স্টিকার লাগানো একটি মোটরবাইকে।

কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত কুমার গোয়েলকে শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বারবার প্রশ্ন করা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ হিসেবে পুলিশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না অথবা নিয়োগের আগে তার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করা হয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি।

মৌমিতার মৃত্যুর ঘটনা পুলিশ প্রথমে আত্মহত্যা বলে পরিবারকে জানালেও, চাপের মুখে পুলিশ স্বীকার করেছে ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। তার শরীরে একাধিক ক্ষত চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছিল পুলিশ। নিহত শিক্ষার্থী উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা হলেও ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতার আর জি কর হাসাপাতালের হোস্টেলের ভেতরে। নিহত শিক্ষার্থীর বাবার দাবি, তার মেয়ের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে জানিয়েছিল পুলিশ।

মৌমিতা দেবনাথের বাড়ি গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকে বের হয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাবা-মায়ের অভিযোগ, ওদের ভেতরেই কেউ আছে। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে। কারও হাত রয়েছে কি না, তা পুলিশকে তদন্ত করে দেখতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা বলেছেন, কীভাবে মেয়েটাকে মেরেছে! দ্রুত এর বিচার করতে হবে। আমরা ফাঁসি চাই। তাই ফাস্টট্র্যাক আদালতে তোলার কথা বলেছি। যাতে দ্রুত বিচার হয়। সমাজে এখনও অনেক লোক আছেন, যারা ভুলে গিয়েছেন নারীদের গায়ে হাত দেওয়া কত বড় অপরাধ। যে কারণেই ফাঁসির সাজা চাইছি।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে খুশি নন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও জুনিয়র চিকিৎসকরা। তাদের বক্তব্য, এতবড় একটা নৃশংস ঘটনা ঘটে গেল। তারপরেও রোববার কেন? কেন এত সময় লাগছে? রোববার হলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। আমরা চাই পুলিশ দ্রুত বাকি অপরাধীদের গ্রেফতার করুক নতুবা বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক।

কলকাতার আর জি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চারতলায় একটি সেমিনার হল রয়েছে। শুক্রবার (৯ আগস্ট) সকালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রী মৌমিতার মরদেহ পাওয়া যায়। খবর জানাজানি হতেই তুমুল উত্তেজনা ছড়ায় হাসপাতাল চত্বরে। স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌমিতা বৃহস্পতিবারও রাত ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডিউটি করেন। পরে কর্মরত আরও দুই জুনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে রাতের খাওয়া শেষ করে পড়াশোনার জন্য সেমিনার হলে চলে যান মৌমিতা। শুক্রবার সকাল থেকে তার আর খোঁজ মিলছিল না। পরে সেমিনার হলের মেঝেতে তার অর্ধনগ্ন মরদেহ পাওয়া যায়।  

এ ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্তের শাস্তি, নিরাপত্তা ও অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিসহ ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজসহ পশ্চিমবাংলার সরকারি হাসপাতলগুলো।

নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে পথে নামেন নারীরা। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেয়েদের রাত দখল’।

‘মেয়েদের রাত দখল’— এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে কলকাতাসহ রাজ্যটির জেলায় জেলার বিভিন্ন রাজপথে নারীরা নেমে আসেন। নারী নেত্রী রিমঝিম সিনহা এই কর্মসূচির ডাক দেন। এ নিয়ে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে আর জি কর হাসপাতালসহ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *