আমসত্ত্ব, রানু খালা এবং টানাটানির সংসার

:: শফিকুল আলম ::

অনেক দিন আগের কথা, আমাদের তখন টানাটানির সংসার। আমার এক খালা বাবার জন্য আমসত্ত্ব আর বরইয়ের গুঁড়ো নিজের হাতে বানিয়ে পাঠাতেন। সেই সময়ে আমাদের সেহরি ছিল আমসত্ত্ব, সাথে দুধ-ভাত; বাবার পছন্দের খাবার, আমাদের সবারই। কাঠের মতো শক্ত সেই আমসত্ত্বকে ঘণ্টাখানেক পানিতে ভিজিয়ে নরম করে ফেলতেন মা যাতে দুধ-ভাতের মধ্যে সেটা সহজেই গলে যায়। খালার আমসত্ত্ব দেয়ার সাথে সাথেই দুধের রং হয়ে যেত সোনালি, আসল আমের ঘ্রাণ ভেসে আসত সেখান থেকে। বাসায় মানুষ ছিল আটজন। তাদের কেউ কেউ বাবার সাথে বসে দুধ-ভাত-আমসত্ত্ব স্মুদির মতো প্লেট থেকে সুড়ুত সুড়ুত করে খেয়ে নিত। হাপুসহুপুস করে ফুরিয়ে যেত সেই দুধ-ভাত; সেহরির শেষ ক্ষণটার সাথে প্রতিযোগিতায় বরাবর জিতে যেত সে।

দশটা বছর হয়ে গেছে – বাবা মা – কেউই আর বেঁচে নেই। রানু খালাও তাই আর তার প্রিয় দুলাভাইয়ের জন্য আমসত্ত্ব বানিয়ে পাঠান না। তার দুলাভাই যে আর কোনদিন বলবে না, ও রানু, তোমার এই বছরের আমসত্ত্বটা কিন্তু গেল বছরের আমসত্ত্বকেও হার মানিয়ে দিয়েছে, হু, একদম, সত্যি বলছি কিন্তু। রানু খালার বয়স এখন ছিয়াত্তর। এখনও হঠাৎ হঠাৎ তিনি তার ভাগিনাদের জন্যে নিজের হাতে বানানো আমসত্ত্ব পাঠিয়ে দেন। কিন্তু আমরা যে আর সেহরিতে দুধ-ভাত-আমসত্ত্ব খাই না? দুধের ভেতর আমসত্ত্ব দিয়ে থালা ভর্তি দুধ-ভাত একবারে সুড়ুত করে খেয়ে ফেলা – আমার সন্তানদের সেটা আদৌ পছন্দ না। ওদের কাছে সেটা খুব বেশি সেকেলে। আমসত্ত্ব ওরা পছন্দ করে ঠিকই – কিন্তু সেটা নাশতার মতো – বেখেয়ালে – অত ঝামেলা করে নয় – যেন তারা চিপস খাচ্ছে – অনেকটা সেরকম।

এমন না যে রানু খালার কাছ থেকে সেই আমসত্ত্ব প্রতি বছর আসত। কিছু মৌসুমে তার আমের গাছে অত আম ধরত না। আবার কখনও এমনও হয়েছে যে খালা আমসত্ত্ব আর বরইয়ের গুঁড়ো বানিয়ে রেখে দিয়েছেন – অথচ পাঠিয়ে দেবার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। রোজা আসার আগে দিয়ে যখন তার আমসত্ত্ব চলে আসত – আমি দেখতাম – মায়ের চোখে মুখে স্বস্তির পরশ। সেহরিতে কে কি খাবে সেটা নিয়ে আর কোন চিন্তাই থাকত না তার। মা জানতেন, তার সবগুলো সন্তান আর তাদের বাবা – সেহরিতে সামান্য দুধ-ভাত-আমসত্ত্ব পেলেই কত খুশি হয়ে যায় তারা সবাই। এমনও হয়েছে যে রানু খালা শুধু বড়ইয়ের গুড়ো পাঠিয়েছেন, সাথে কোন আমসত্ত্ব নেই। দুধ-ভাতের সাথে সেই বরইয়ের গুঁড়োই খেয়ে নিতেন বাবা – অনেক সন্তুষ্টির সাথে। আমাদের ভাই বোনদের ভেতরে কারো কারো সেটাতে মন ভরত না। কোথায় দুধ-ভাত-আমসত্ত্ব আর কোথায় দুধ-ভাত-বরইয়ের গুঁড়ো! এটা কোন তুলনা হলো? কি বলে এসব?

দশটা বছর হয়ে গেছে – বাবা মা – কেউই আর বেঁচে নেই। রানু খালাও তাই আর তার প্রিয় দুলাভাইয়ের জন্য আমসত্ত্ব বানিয়ে পাঠান না। তার দুলাভাই যে আর কোনদিন বলবে না, ও রানু, তোমার এই বছরের আমসত্ত্বটা কিন্তু গেল বছরের আমসত্ত্বকেও হার মানিয়ে দিয়েছে, হু, একদম, সত্যি বলছি কিন্তু। রানু খালার বয়স এখন ছিয়াত্তর। এখনও হঠাৎ হঠাৎ তিনি তার ভাগিনাদের জন্যে নিজের হাতে বানানো আমসত্ত্ব পাঠিয়ে দেন। কিন্তু আমরা যে আর সেহরিতে দুধ-ভাত-আমসত্ত্ব খাই না? দুধের ভেতর আমসত্ত্ব দিয়ে থালা ভর্তি দুধ-ভাত একবারে সুড়ুত করে খেয়ে ফেলা – আমার সন্তানদের সেটা আদৌ পছন্দ না। ওদের কাছে সেটা খুব বেশি সেকেলে। আমসত্ত্ব ওরা পছন্দ করে ঠিকই – কিন্তু সেটা নাশতার মতো – বেখেয়ালে – অত ঝামেলা করে নয় – যেন তারা চিপস খাচ্ছে – অনেকটা সেরকম।

এই তো সেদিন খালাকে দেখতে মাগুরায় গেলাম। উনি এখন একটা গ্রামে থাকেন – নাম পিপরুল। খালা তার দুলাভাইয়ের স্মৃতিচারণ করলেন – নিজের হাতে বানানো থালার সমান জাম্বো সাইজের সোনারঙ্গা আমসত্ত্ব – কি ভালোই না বাসতেন তার দুলাভাই। বলতে বলতে খালার চোখ দু’টো ভরে উঠল। আর আমি শুনতে পেলাম স্পষ্ট – বাবা বলছেন, “রানুর চেয়ে পৃথিবীতে এত মজার আমসত্ত্ব কেউ বানাতে পারে নাই”।

আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,

তাহাতে কদলী দলি,

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—

হাপুস হুপুস শব্দ

চারিদিক নিস্তব্ধ,

পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।

[ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জেহান আলী ]

লেখক: বাংলাদেশ ব্যুরো চীফ, এএফপি

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *