:: মাওলানা ফুয়াদ আল ফারুকী ::
তারিখ: ২৭ আগষ্ট ২০১৪ বুধবার, স্থান: ১৭৪ পূর্ব রাজাবাজার, গ্রীনরোড, ফার্মগেট, ঢাকা। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পরে আব্বা শহিদ শাইখ মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রাহঃ) ড্রইং রুমে পড়তে বসেন অন্যান্য দিনের মত। বাসায় তখন ছিলেন আমার আম্মা, নানি, একজন মহিলা মোহাম্মদপুর থেকে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন মেয়ের বিয়ে ঠিক দোয়া নিতে। তিনি অনেক আগে থেকেই আমাদের পরিচিত ছিলেন আব্বুর অনুষ্ঠান দেখতেন টেলিভিশনে সেই সুবাদে আরকি। আর ছিলো আমাদের বাসার একজন গৃহকর্মী মহিলা ও আমার আপন মামাত ভাই মারুফ হাসান যে সম্পূর্ণ ঘটনার একমাত্র পুরুষ প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
হঠাত বাসায় বেল বেজে উঠলে দরজা খুলেন মারুফ হাসান। আমাদের বাসায় দুটো দরজা, একটি পশ্চিম দিকে যা দিয়ে সরাসরি ডাইনিং ও সেখান থেকে সরাসরি আব্বুর মাস্টার বেড এ যেখানে আব্বু ঘুমাতেন। অপর দরজাটি দক্ষিন দিকে যেটি সরাসরি ড্রইং রুমে, মেহমান আসলে সেই দরজা দিয়ে সাধারণত মেহমানদের বসতে দেয়া হত ও সেখানেই আব্বু পড়াশোনা করতেন।
মারুফ হাসান পশ্চিমের দরজা খুলে জিজ্ঞাস করলেন আপনারা কারা কি জন্য তারা বলে যে আমরা হজ্জে যেতে চাই হুজুরের এজেন্সিতে উনার সাথে কথা বলতাম। লোকগুলো সকলেই যুবক থেকে মধ্যম বয়ষ্ক ছিলো। পরনে সবারই শার্ট, গেঞ্জি, পেন্ট পরিহিত। তাদেরকে এবার দক্ষিনের দরজা খুলে দিয়ে ড্রইং রুমে বসতে দেয়া হয়। সেখানে এসি ছাড়া হয় মেহমানদের জন্য সোফায় কিছু লোক বসে আর কিছু খাটে ২ জন মনে হয় দাঁড়িয়ে ছিলো। ৭ জনের মত লোক।
এবার আব্বু বললেন, ভাই এ বছর তো হজ্জ শেষ আপনারা এসেই যখন পরেছেন চা খেয়ে যান সামনের বছরের হজ্জ এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করুন। তারা বলল সামনের বছরই যাবো সেই নামগুলোই এন্ট্রি করাতে এসেছি। আমাদের সাথে আরো কয়েকজন যাবেন তাদের কে কি ডেকে আনবো? আব্বা বললেন, জ্বি ডাকুন! কল করে ডেকে আনলো আরো ৭-৮ জন। আব্বু থাকা কালে উনার সামনে সাধারণত নাম পরিচয় জানতে মেহমানদের বেশি জিজ্ঞাসা করলে আব্বু রাগ করতেন, নিজেই পরিচিত হতে পছন্দ করতেন।
এবার ঘর ভরে গেলো ১৪-১৫ জন মানুষে। আব্বু বললেন, মারুফ ভিতর থেকে চেয়ার নিয়ে আসো সবাইকে বসতে দাও। ড্রইং রুম থেকে ডাইনিং এ আসতে যে দরজা ছিলো যেটা খুলে এক রুম থেকে অন্য রুমে গেলে অটো বন্ধ হত দরজা। এসিরুম থাকায় এ ব্যবস্থা ছিলো প্রতিটি দরজায় ফোম লাগানো এয়ার টাইট করা ছিলো। মারুফ হাসান চেয়ার নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই শুকনো মাটিতে আছাড় খেলো যা দেখে তা হলো, এই খনিকের মধ্যেই দুপাশে দুজন আব্বুকে মাথায় পিস্তল ও চাপাতি ধরে চুপ চুপ বলতে বলতে মারধর করছে। মুহুর্তেই কয়েকজন ঘরের পর্দা বিছানার চাদর কাটছে বাধার জন্য, আর কিছু বুঝে উঠতেই মারুফকে এক ধাক্কা দিয়ে বিছানায় আরেক মুহুর্তেই লাথি ও পিস্তলের বাট দিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত করতে শুরু করে। এই সব কাজগুলোই কয়েক সেকেন্ডের ব্যপার ছিলো মাত্র। মুহুর্তেই মারুফকে নিস্তেজ করে কয়েকজন, কয়েকজন আব্বুকে বেধে ফেলে।
বাঁধার প্রক্রিয়া ছিলো খুবই করুন। বড় বলের মত করে কাপড় মুখে পুরে দিয়ে হা করিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে একটি কষে বান, চোখ কষে বান, দু হাত ও দু পা পিছনে ফোল্ড করে পেছন দিকেই দু হাত ও পা একত্রে কষে বান। এবার মাস্টার বেডে যেখানে মহিলারা সেখানে ৭-৮ জন হুর হুর করে ঢুকে যায়। হতভম্ব হয়ে আম্মু শুধু দুটি কথা বলার সুযোগ পায় তোমরা কারা এভাবে অভদ্রের মত রুমে ঢুকে গেলে কেন? হত্যাকারীরা যে কথাটি বলে তা প্রায় আজ আব্বু চলে গেছেন ১০ বছর এই দশ বছরে আমরা বলতে পারিনি। সাংবাদিকরা পর্যন্ত আমাদেরকে নিষেধ করেছে যে, এই কথাটা বললে আপনারা বিচার পাবেন না।
কথাটি হলো তারা বলে আম্মুর কথার জবাবে “আমরা আওয়ামী লীগ করি, বাইরে মিছিলে পুলিশ ধাওয়া করছে তাই আশ্রয় নিতে আসছি”। পরবর্তীতে এনটিভি, একাত্তর টিভি, সময় টিভি নিষেধ করে এবং আম্মার দেয়া বক্তব্য থেকে এই অংশ কেটে দেয়। দ্বিতীয় আম্মু বলেন তোমরা জানো আমি একজন আলেম ও ইমাম সাহেবের স্ত্রী আমার গায়ে যেন হাত না লাগে।তারা এই দুটো কথার মাঝেই সেই রুমেরও পর্দা ও চাদর কেটে মুহুর্তেই একই কায়দায় সবাইকে বেধে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে আর বলতে থাকে একটু পর পর কানের কাছে যে, “সামান্য নড়াচড়া করলে শুধু টান দিমু”।
তারা কয়েকভাগে কাজগুলো করেছে কেউ কাপড় কেটে রশি বানানোর কাজ, কেউ বাধার কাজ। এরপর শুরু হয় সব লুটপাট। বাসার সকল আসবাবপত্রের তালা ভেঙ্গে নগদ অর্থ স্বর্নালঙ্কারসহ মহিলাদের পরনে থাকা সব কিছুই নিয়ে যায়। হঠাৎ এর মাঝে ময়মনসিংহ থেকে আসা মুরুব্বি ৩ জন লোক বেল বাজালে, বাসায় দক্ষিনের গেট খুলে ড্রইং রুমে থাকা হত্যাকারীরা তাদেরকে এক ধাক্কা দেয় পশ্চিমের দরজা দিয়ে। তারা আতখা গিয়ে দক্ষিনের দরজা দিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে আব্বুকে করুন অবস্থায় বাধা দেখতে পেয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদেরকেও একই কায়দায় বন্দি হতে হয়। তারা এসেছিলেন মূলত আব্বুকে মাহফিলের দাওয়াত করতে।
এদিকে মহিলারা বিশেষ করে আম্মু ভাবতেছিলেন তারা হয়ত ডাকাত লুটপাট করেই চলে যাবে। দক্ষিনের ড্রইং রুমে মারুফকে এতটাই কষে বাধা হয়েছিলো অসহ্য যন্ত্রনায় সামান্য নড়লেও তার উপর তাঁকে লাথি ও পিস্তলের বাট দিয়ে প্রচন্ড মারা হচ্ছিলো। মারুফ তখনও কানে শুনছে। তারা খুবই ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলো পরস্পরে উভয় রুমেই। এ রুমের মানুষ ঐ রুমে কি হচ্ছে জানছে না।
আব্বুর জীবনের শেষ কথাগুলো যা বলছেন, আমার অমুক অমুক যায়গায় চাবি আছে; তোমরা যা নেয়ার নিয়ে যাও। তোমরা আমার হাতকে পিছনে বেঁধো না, আমার হাত পিছনে যায়না ভাঙ্গা, সামনে বাধো। মারুফকে অস্বাভাবিক মারধর করা দেখে বলেন, তাঁকে তোমরা মেরো না সে আমার ছেলে না, আমার ছেলেরা কেউ বাসায় নেই। তোমরা কেন এসেছো, কি চাও আমার কাছে? তারা বলে আমরা যা করতে এসেছি তা করে চলে যাব। তুই জীবনের শেষ দোয়া কালাম পড়। আব্বার তখন বুঝার বাকি রইলো না। শাহাদাহসহ বিভিন্ন দোয়া সেদিন আব্বু পড়েছিলেন।
আব্বুকে অনেক মারে তারা, অকথ্য ভাষায় গালাগালও করে তারা। একপর্যায়ে মারতে মারতে ড্রইং রুম থেকে মাঝখানে ডাইনিংয়ে এনে তারা আব্বুকে গলায় পাগড়ি পেচিয়ে দু পাশ থেকে টেনে ফাঁসের মত করে ধরে, হয়ত মৃত্যু কষ্টে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই তিনি ছুটতে চাইলে তার বুকের উপর ছুড়ি দিয়ে ২টা ঘা দেয়া হয়, যা হয়ত উনার ছটফটানিকে কিছুটা নিস্তেজ করলে মেঝেতে লুটিয়ে পরে। পূর্ব পশ্চিম করে তারা আব্বুকে গলার এপার থেকে ওপার ছুড়ি চালিয়ে দেয়, ফিনকি দিয়ে রক্তে ভেসে যায় সাথে সাথে।
আব্বুর মুখে তখনও বড় কাপরের বল ও হাত সামনে বাধা ছিলো। রক্তের স্রোত ঠেকাতে কয়েক পলট করে পাগড়ী গলাতেই পেচিয়ে রেখেছিলো। আম্মু প্রথম সারাশব্দ না পেয়ে হাতের বাধন খুটে খুটে খুলতে সক্ষম হন। আর খুলেই প্রথম চোখ খুলে আব্বুর খোজে দৌড়ে মাঝের রুমে এসে দেখেন আব্বু মেঝেতে শুয়ে আছেন সামনে হাত বাধা নিথর দেহ। কিচেন থেকে একটা ছুঁড়ি এনে আগে হাতের বাধন কাটেন পরে গলার বাধন সরাতেই তখনো তাজা রক্ত গলগলিয়ে বের হতে দেখে শুরু হয় আম্মুর বিলাপ। ঠিক তখনই প্রথম ঘরে প্রবেশ করে আমার সেঝো ভাই ফয়সাল ফারুকী। সে ধানমন্ডি কোচিংয়ে ছিলো। এসে সে দরজা খোলা দেখতে পেয়ে ঢুকেই আম্মুর বিলাপ দেখে পাশের বাসার মানুষসহ বাড়িওয়ালা ও সবাইকে ডাক দিয়ে আনে।
আমি ছিলাম মোহাম্মদপুর হোস্টেলে। মেঝো ভাই আহমাদ রেজা ফারুকী ছিলো সৌদি আরবে।বড়ভাই মাসুদ বিন নুর ছিলেন চাকুরীতে দেশের বাহিরে। বোনেরাও বাহিরে ছিলো। তৎকালীন কুখ্যাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল সেদিন গ্রীনরোডেই মিটিংয়ে ছিল। আমাদের বাসা থেকে মাত্র ৩০০-৪০০ গজ দূরেই। তখন মূলত চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি ছিলো সাগর-রুনি হত্যাকান্ড নিয়ে, তাদের বিষয়ে সকল সাংবাদিক ও সর্ব মহল তোড়জোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো। তারা ২০১২ সালেই ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম রাজাবাজারে আমাদের বেশ কাছাকাছি থাকতো, ছুরিকাঘাতে নিহত হন এই দম্পতি। সেই ফাকে আওয়ামীদের জামায়াত নেতাকর্মীদের ধরপাকড় তৎপরতাও অনেক জোরদার ছিলো। ঘটনা পরবর্তীকালে প্রশাসন এর অনেক লোক বলেছে, আমরা জানলেও বলতে পারবো না আমাদের হাত পা বাধা, তাদের মধ্যেও আব্বুর ভক্ত ছিলেন অনেক। আমরা রক্তের দাগসহ আঙুল এর ছাপ একটি জমা রশিদ বইয়ে ছিলো সেটিও তদন্তকারীদের কাছে দিয়েছিলাম, ১০ বছরেও তাদের এহেন বিচার পক্রিয়াতে আমাদের প্রবল ধারনা তখন থেকেই এটা ছিলো যে, সেই হত্যাকান্ডের (সাগর-রুনি) ধামাচাপা দিতেই মূলত বলির পাঠা করা হয়েছিলো আব্বাকে। নিঃস্ব করে ফেলা হয়েছিলো আমাদের পরিবারকে। তা না হলে স্বৈরাচারীকে গালি দিলে পরদিন তাকে ভারত থেকে ধরে আনা সম্ভব হলে ১০ বছরেও বাবার বিচার কেন করতে পারছে না? কারন হত্যা দিয়ে হত্যা, ইস্যূ দিয়ে ইস্যূ ধামাচাপা দেয়ার এমন ঘৃণ্য কূটকৌশল আওয়ামীদের অনেক পুরনো নীতি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মহোদয়ের কাছে আমাদের পরিবারের আকুল আবেদন ও দাবি যেন, আমার আব্বু মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলা বিশেষ নির্দেশনায় পুন:তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া চালু করা হয়।
হাফেজ ক্বারী মাওলানা ফুয়াদ আল ফারুকী: মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর সন্তান