এস আলমের ব্যাংক হিসাবে ২৪২০০০ কোটি টাকার লেনদেন

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল আলম মাসুদ পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের হিসাবে ২ লাখ ৪২ হাজার টাকার জমা হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বিগত পাঁচ বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে ওই লেনদেনের তথ্য পেয়েছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ও কর কর্মকর্মতাদের নিয়ে আয়কর গোয়েন্দার আয়োজিত ‘কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি’র কর্মশালায় এসব তথ্য তুলে ধরেন সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে একটি শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংক হিসাবে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য আছে। সাতজন কর কর্মকর্তা এক মাসেও ১০টি কম্পিউটারে ওই লেনদেনের তথ্য এন্ট্রির কাজ শেষ করতে পারেননি। ২০২৪ সালের ৩০ জুন ওই শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংক হিসাবে স্থিতি ছিল ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যার বিপরীতে সুদ পেয়েছেন ৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। অথচ এসব অর্থের বড় অংশই ওই শিল্পগোষ্ঠীর আয়কর নথিতে দেখানো হয়নি। এখন আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।

সিআইসির মহাপরিচালক বলেন, এস আলমের দুই ছেলে জালিয়াতি করে ৫০০ কোটি টাকা হোয়াইট করেছে। কিন্তু ওই ব্যাংক আজ পর্যন্ত আমাকে তথ্য দেয়নি। তদন্ত করে দেখা গেল, এসআইবিএলের পটিয়া শাখায় ২১ ডিসেম্বরে পে অর্ডার কেটেছে। পরে ক্লিয়ারিং হয়। অথচ আইন শেষ হয়ে গেছে ৩০ জুন। তখন সে ব্যাংক ওলটপালট করে আগের ডেটে পে অর্ডার দেয়। এটা হেড অফিস থেকে করা হয়। আরও অনেক সমস্যা আছে।

এস আলমের ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির তথ্য তুলে ধরে সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে মানবসভ্যতা সৃষ্টির পর সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং জালিয়াতি হয়েছে বাংলাদেশে। এই কোম্পানিটির ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। ১০টি কম্পিউটারে ৭ জন কর্মকর্তা এক মাস যাবৎ এন্ট্রি দিয়ে শেষ করতে পারেনি। তারা ৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যাংক সুদ আয় হলেও আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেনি। এ নিয়ে এখনো কাজ চলছে। এতো বড় কাজ কখন শেষ হবে তাও বলতে পারছি না। কেবল ব্যাংক সহযোগিতা করলেই কাজ দ্রুত শেষ করা সম্ভব। আর দেরি করলে রাষ্ট্রের কাজ বিলম্বিত হবে। কাজ বিলম্বিত হয়ে রাজনৈতিক সরকারের ওপর পড়লে এই অলিগার্করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আঁতাত করে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। 

এস আলম বিদেশি নাগরিকত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্মগ্রহণ করেও নাগরিকত্ব বাতিল করে এস আলমের দুই ছেলে এন্টিগুয়া, সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নিয়েছে। সেখানে নাগরিকত্ব নিতে গেলে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ লাগে। তার দুই ছেলে জালিয়াতির করে ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করে। তাদের বিষয়ে ৯ আগস্ট ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করা হলেও সেই ব্যাংক এখনো বিবরণী জমা দেয়নি। ব্যাংক সহযোগিতা না করায় তদন্ত কাজ অন্তত ৬ মাস পিছিয়ে গেছে। 

ব্যাংক ভুল তথ্য দিচ্ছে উল্লেখ করে আহসান হাবিব বলেন, কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়। ব্যাংক থেকে যেই হিসাব বিবরণী পাঠানো হয়েছে তাতে শূন্য লেনদেন দেখানো হয়। কিন্তু আমরা ওই ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে ৩৭৯ কোটি টাকা পেয়েছি। এ বিষয়ে ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তলব করলে তারা সদুত্তর দিতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর এস আলমের মতো নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য এনক্রিপ্ট (লুকানো) করে রেখেছে। ভুল তথ্য দেয়ায় এখন পর্যন্ত ৭ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে শোকজ করা হয়েছে। আয়কর বিভাগ এখনো এসব বিষয়ে সফটলি ল’ এনফোর্সমেন্ট করছে। যথাযথভাবে প্রয়োগ শুরু করি তাহলে ব্যাংক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কখনোই আমরা সেটি করতে চাই না। কারণ আমরা ‘নীল কর’ আদায় করতে চাই না। মোটিভেশনের মাধ্যমে কর আদায় করতে চাই। 

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো করদাতাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়, ভুয়া ব্যাংক বিবরণী পাঠায়, বিলম্বিত করে ব্যাংক হিসাব বিবরণী পাঠায়, পরিবারের ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে তথ্য দেয় না। শীর্ষ এক ধনীর স্ত্রীর লকার থেকে ১৫ কোটি টাকার ডায়মন্ড পেয়েছি। ১৫ কোটি টাকার এডিআর পেয়েছি। অন্য ২ কোটি টাকা দলিলমূল্যের জমি মর্টগেজ দিয়ে ৪৭ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এ তথ্যগুলো আমরা ব্যাংক থেকে পাইনি।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে আহসান হাবিব বলেন, অলিগার্করা আর ফিরে আসবে না। এই ভরসায় থাইকেন না। এস আলম তার ড্রাইভারকে চাকরি দিয়েছে, কাজের বুয়াকে ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। কে কাকে চাকরি দিয়েছে, কে কাকে সুবিধা দিয়েছে, কে কার আত্মীয় আপাতত ভুলে যান। কর বিভাগকে সহযোদ্ধা হিসেবে সহযোগিতা করুন। আর ব্যাংক সহযোগিতা না করলে সেপ্টেম্বরের পর থেকে আইন প্রয়োগ শুরু করবো।  

বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-আয়কর) কমিশনার খাইরুল ইসলাম বলেন, অনেক কোম্পানির ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, টাকা শুধু উত্তোলনই হচ্ছে। এই টাকা কোথায় যায়, তা খুঁজে পাচ্ছি না। প্রতিদিনই টাকা উত্তোলন হচ্ছে। কোথায় টাকা যাচ্ছে, তা প্রশ্ন করলে ব্যাংক উত্তর দিতে পারছে না।

এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, কর বিভাগের চাহিদা অনুসারে তথ্য দেওয়া ব্যাংকের আইনি দায়িত্ব। তথ্য না দিলে আইনে কঠোর হওয়ার কথা বলা আছে। সেটি হলে ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে খেলাপি হয়ে যাবে। তখন ওই সব ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।

খায়রুল ইসলাম বলেন, অনেকের ব্যাংক হিসাব বিবরণী এনে দেখেছি, প্রতিদিন বিপুল অর্থ উত্তোলন হচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, জানি না। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারেন না ব্যাংক কর্মকর্তারা।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘শুধু আজই একটি কার্যরত ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ১২১ কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে।’

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত দুর্নীতির তথ্য প্রকাশের প্রত্যয় ব্যক্ত করে সিআইসির ডিজি বলেন, ‘আমার কাছে বহু ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে, যেখানে অসংখ্য অনিয়মের তথ্য সংরক্ষিত আছে। এখন সময় এসেছে এসব তথ্য প্রকাশের।’

খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক করদাতার ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিদিন বিপুল অঙ্কের অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে, কিন্তু সেই অর্থের গন্তব্য সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ব্যাংক কর্মকর্তারাও কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না।’

এদিকে ব্যাংক খাতে অনিয়মের বিষয়ে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘ব্যাংক কর্মকর্তারা কর কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি জানান, আর্থিক খাতের নজরদারি বাড়াতে তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ব্যবহার করেই সব লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়।

গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের শীর্ষ স্থানীয় শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় কর গোয়েন্দা সেল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন কর গোয়েন্দারা। ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আছে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *