কবি অসীম সাহার কয়েকটি কবিতা

:: নাগরিক সাহিত্য ডেস্ক ::

প্রয়াত কবি অসীম সাহার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করা হল। নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে কবি অসীম সাহার কবিতা প্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে বলে আশা করছি।

 প্রতিবন্ধকতা

আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণে ভেসে যাবে সমগ্র পৃথিবী-
এই ভেবে বিরহী যক্ষের মতো যখন আকাশের দিকে
আকুল নয়নে তাকিয়ে রয়েছি, তখন আমাকে বিস্মিত
করে সজল-সঘন কালো মেঘ কখন যে অসভ্য ছেলের
মতো চোখ ঠেরে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে- আমি তা টেরও পাইনি।
তার মানে এখন আর মেঘলা-ধূসর আকাশের কোনো
অস্তিত্ব নেই- তার বদলে প্রকৃতিকে গৃহবন্দি করে
সে এখন খোশমেজাজে যত্রতত্র ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অথচ কথা ছিলো, বাদল-বরিষনে তুমি এসে বসে থাকবে
কদমতলায়, আর আমি একটি হৃদয়ের ব্যাকুল বাঁশির সুর
শুনতে পাই বা না পাই, ঝড় ও বৃষ্টির জল উপেক্ষা করে
আমার পদ্ম-কোমল পা দুটো চেপে-চেপে নিজের রক্তের
ভেতর দিয়ে প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে আসবো তোমার কাছে।
কিন্তু আষাঢ়ের প্রকৃতি হঠাৎ এমন করে বেয়াড়া হয়ে উঠবে,
কে তা জানতো? বর্ষাও যে কখনো কখনো এমন বেরসিক আচরণ
করতে পারে, জীবনে এই প্রথম আমি তা প্রত্যক্ষ করলাম।
অতএব কী আর করা? আবার নতুন দিনের প্রতীক্ষা ছাড়া
তোমার কিংবা আমার আর তো কিছুই করার নেই।
তাই এসো, এই অলস ও উদাস অবসরে উভয়ে উভয়কে
বহফোনে এমন কিছু বার্তা পাঠাই, যাতে প্রবল বর্ষণের
মধ্যে যে ভয়ংকর বজ্রপাত হয়, আর তাতে কেঁপে ওঠে
সহজ হৃদয়, তেমনি করে শিহরনের ছোঁয়া লেগে
দু’জনেই কেঁপে উঠি, আর তুমি যেন আমাকে কিছুতেই
ভুল বুঝে বাঁশির সুর থামিয়ে দিতে না পারো- অন্তত
যেন বুঝতে পারো, সত্যিই আমি পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে,
আমার কোমল দুটি পা টিপে টিপে, দুর্গম পিচ্ছিল পথ
পেরিয়ে তোমার দিকেই ছুটে আসতে চেয়েছিলাম,
তা যেন সত্যিই আমি তোমার কাছে প্রমাণ করতে পারি।

কিন্তু তুমিই বলো, প্রকৃতি যদি আমাদের সহায় না হয়, তা হলে
ইচ্ছে থাকলেও আয়ান-ঘরণী হয়ে আমি কেমন করে
প্রকাশ্য দিবালোকে তোমার দিকে আকুল হৃদয়ে ছুটে আসতে পারি?
তুমি যদি কৃষ্ণ না হয়ে আমার হাতে তুলে দিতে তোমার
মর্মহরণকারী বাঁশি, তা হলে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারতে,
অবরুদ্ধ সংসারের প্রজাপতি-জাল ছিন্ন করে তোমার কাছে ছুটে
যেতে গিয়ে আমাকে কতোটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে !

তাই বলছি, প্রয়োজনে তোমার চোখের জলে আমাকে ভাসিয়ে দাও,
তবু গোমড়া আকাশের মতো অমন মুখ ভার করে বসে থেকো না।
তুমি যদি আমার ওপর অমন অভিমান করে বসে থাকো,
তা হলে আমি বলবো, ‘এ জন্মেই কৃষ্ণ না হয়ে তুমি অন্তত একবার
আয়ান-ঘরণী হয়ে দেখো, কাজটা সত্যি সত্যিই অতটা সহজ নয়’ !

গোলাপের কাঁটা

কাঁটার আড়ালে ক্ষতবিক্ষত।
একটি বর্ণিল প্রজাপতি একা-একা উড়ে-উড়ে
গাছের পাতার ওপরে গিয়ে বসলো।
ডানা দুটো নড়তে লাগলো তার। মনে হলো,
তার হৃদয়ের ভেতর ভয়ের সলতেগুলো
মৃদু বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে।

এখন এই বাগানে প্রজাপতির জন্যেও
কোনো নিরাপদ আশ্রয় নেই। মানুষেরা
এখনো স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তাই
প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়িয়ে
নিয়ে যেতে চায় ইচ্ছের সবগুলো ফুল।
অথচ প্রজাপতি উড়তে পারে না—তার ডানা
আটকে যায় শূন্যতার তীক্ষ্ণ কালো থাবায়।
বাগানের যে-ফুলগুলোতে আগে কোনো
কাঁটার আবরণ ছিলো না, যে-ডালে
ছিলো না কোনো কীটপতঙ্গের ভয়—
এখন সেই ডালে এসে বসেছে ভয় দেখানোর
পোশাক-পরা বুনো শুয়োরের দল।
তাদের উন্মাদ চিৎকারে ভেঙে চৌচির
হয়ে যাচ্ছে চরাচর, অরণ্য, প্রকৃতি।
যেন আদিম আলখেল্লা গায়ে
পৃথিবীতে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার।
তারই মধ্যে সুন্দরের স্বপ্নকে বুকে করে
নকশীকাঁথার গায়ে সারাদিন-সারারাত
মানুষের বিজয়ের ইতিহাস লিখে যাচ্ছে
সহস্র গোলাপের কাঁটা।

আমার এ-ভয় অন্যরকম

তোমরা সবাই ভয় পাও এই বাইরে যেতে
দুয়ার খুলে বাইরে যেতে
পথ পেরোতে
গাড়ির ভিড়ে বড়ো রাস্তা পার হতে যেই পা বাড়ালে
ভয় পাও এই আগুন দেখে
বারুদ দেখে
দোজখ দেখে ভীষণ রকম গজব দেখে খোদাতালার
তোমরা সবাই ভয় পাও এই দাঙ্গা দেখে
মড়ক লাগলে মহামারী এমনি কিছুর
ভয় পাও ঠিক রাত-বিরেতে অন্ধকারে
যাকে তাকে দেখলে হঠাৎ
হয় পাও এই সাপের বাঘের
চোর-ডাকাতের দৈত্যদানা জলপুলিশের
অনেক কিছুর ভয় তোমাদের
ভয় তোমাদের বাইরে কেবল চেখের ওপার,
আমার এ-ভয় অন্যরকম
অন্য কিছুর
আমার কিছুর
আমার এ-ভয় বাইরে তো নয়
ঘরের ভিতর নিজের ভিতর
আমার এ-ভয় নিজেকে ভয়
আমার এ-ভয় শোবার ঘরে বাথরুমটির
ঠাণ্ডা জলের টবের ভিতর
দাড়ি কাটার লম্বা ক্ষুরে
চায়ের কাপে কাঁটা-চামচে
আমার এ-ভয় আলমারিতে
বইয়ের তাকে ফুলদানিতে
মুখ দেখবার আয়না খুলে ড্রয়ার খুলে
আমার এ-ভয়
আমার এ-ভয় শত্রুকে নয় প্রিয়ার চোখে
নরম ঠোঁটে
নিজের দুটি করে মাঝে নখের ভিতর
আমার এ-ভয় অন্যরকম অন্যরকম।

চিকুন গুনিয়া

কেমনতরো রোগ ওরে ভাই এই যে ‘চিকুন গুনিয়া’
এক আঘাতে মুহূর্তে সে কাঁপাচ্ছে সব দুনিয়া।
ধরছে যাকে, মারছে তাকে, এমন মারা মারছে ভাই
দেহের ভেতর, হাড়ের ভেতর হাতুড়িটা মারছে ঘাই।
‘ও বাবা গো, ও মা গো মা’ বলেই সবাই হচ্ছে কাৎ
চিকুন ব্যাটার আক্রমণে, নিথর দেহ অকস্মাৎ।
জ্বরের সঙ্গে বমি রে ভাই, অচৈতন্য সব দেহ
ভালো করে দেখলে পড়ে, মনে হবে শবদেহ।
এমন রোগ তো দেখিনি ভাই, মশার এমন কঠিন তেজ!
তার কামড়ে মানুষ হয়েও কাঁপছে যেন সবার লেজ।
ঘরে ঘরে ঢুকে চিকুন, মারছে ব্যথায় মানুষকে
এক ঘায়েতে মানুষ কাহিল, করছে কি কাৎ ফানুসকে?
যা খুশি তা করুক চিকুন, চলুন আমরা সুস্থ হই
স্বাধীন দেশে থাকবে চিকুন, মানবো না তা কিচ্ছুতেই।
আসুন সবাই একসাথে হই, তাড়াই `চিকুন গুনিয়া’
বাঁচুক দেশের মানুষগুলো, মশারি দেই বুনিয়া।

কবি নামের চামচা

কবি নামের চামচা আছে
গলায় তাদের গামছা আছে
কবি আছে নানান রকমফের;
আমলা দেখে হাত কচলায়
তেল মারে আর মাছ খচলায়
দুই আনাতে কবি বিকোয় ঢের!
অকবিদের কবি বানায়
তাদের কি আর কবি মানায়?
দামড়া কিছু কবি আছে
তাদের বুকে ছবি আছে
বলতে পারো সে-সব ছবি কাদের?
গুলশানেতে বাড়ি আছে
সাপ্লাইয়ের নারী আছে
হরেকরকম মুখোশ আছে যাদের।
টাকার জোরে, মামার জোরে
দেশ-বিদেশে তারাই ঘোরে
উৎসবেতে তারাই যে হয় গণ্য;
কবিতা আর শিল্প তো নয়
ক্রমশ তা হচ্ছে যে ক্ষয়
কবি নামের অকবিদের জন্য!

তোমাকে ছাড়া

তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো
লতাপাতার উৎসাহ দেখে আমি সারাদিন তার কাছে ঘুরে বেড়াতাম
কোনো কোনো দেন পাখিদের
বাষভূমিতে আমার অনেক উপাখ্যান শোনা হতো
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন প্রত্যহ সূর্যোদয় দেখতে যেতাম তোমাদের বাড়ির পুরনো ছাদে
তোমার সেই যে দজ্জাল ভাই সারারাত তাস খেলে এসে
পড়ে পড়ে তখনো ঘুমাতো,
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন আমার রোজ ভোরবেলা ঘুম ভাঙতো, যেতাম
প্রকৃতির কাছে মানবিক অনুভূতি নিয়ে
মানুষের দুঃখ দেখে আমার তখন ভীষণ কান্না পেতো
এখন আমার আর সেই অনুভব ক্ষমতা নেই
মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাপ দেখেও আমি দিব্যি চায়ের দোকানে
বসে হাসতে হাসতে চা খাই
সেলূনে চুল কাটার সময় পাশেই অবৈধ কতো কী ঘটে যায়
তুমি কাছে না থাকলে আমি দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠি
আশেপাশে সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি
মানুষ ও প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমার হিংসা বোধ হয়
তুমি না থাকলে মেয়েদের রূপ কিংবা ফাহমিদা খাতুনের
রবীন্দ্রসঙ্গীত কিছুই আমাকে আকর্ষণ করে না
শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ জাগে না আমার
একে একে সকাল দুপুর সারাদিন নষ্ট হয়
কোনোকিছুই করতে পারিনে আমি
তুমি না থাকলে বড়ো দুঃসময় যায়, সর্বত্র বন্ধুবিহীনভাবে
বাস করি
এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়
কাউকি ডাকলে সাড়া দেয় না, সবাই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে
তুমি না থাকলে এই বাড়িঘর শহরের লোকজন
সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত মনে হয়
নিজেকেই নিজের অচেনা লাগে
মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি
তুমি না থাকলে বাস্তবিক আমি বড়ো কষ্টে পড়ি
বড়োই কষ্ট হয়।

জ্যাকুলিনের দ্বিতীয় বিবাহের পর

তুমি বড়ো জীবনকে ভালোবাসতে, জ্যাকুলিন
সুখ কোথায় থাকে, ভালোবাসা কোথায় তার
ক্যাম্পখাট বিছিয়ে ঘুমায়
তোমার চেখের নিচে ভালোবাসার সবুজ ঠিকানা
তোমার গুপ্ত বুকে দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনি
ঐশ্বর্যে তোমার বড়ো সাধ
তুমি চাও জুয়েলারী, টয়লেট,
ছিমছাম সোনালি মোজেক ;
দুঃখকে তোমার বড়ো ভয় জ্যাকুলিন,
দুঃখকে তোমার বড়ো ভয়
দুঃখ কি দেখেছো খুলে তার কালো বাক্স থেকে দেখতে কেমন
তার সারা মুখে ব্রণের দাগ, নিগ্রোদের মতো ভাঙা গলার স্বর
দুঃখ বড়ো ভয়ঙ্কর, দুঃখকে পাশে নিয়ে তুমি কিছুতেই ঘুমোতে
পারবে না
বড়ো শকাত দুঃখের সাথে রাত জাগা
বিশেষত তোমার অভ্যাস নেই,
জ্যাকুলিন, তোমার চাই ভালোবাসার বাসস্থান,
সম্পদ, দম্পতির সুখভোগ
তোমার চোখের নীল সমুদ্রে চাই ওনাসীদের সমসন্ত জাহাজের মালিকানা
জাঁকজমক, যা কিছু ইচ্ছে খরচবরাদ্দ,
তোমার যৌবনে চাই ভুলচুক, প্রকৃতির রক্তমাংস
সন্মৃতির ঝাপসা আংনায় তুমি কারো ফ্যাকাসে মুখ দেখে
এক থাকতে পারো না,
কেনেডীর মৃত্যু যতো করুণই হোক, জ্যাকি, তুমি এক
থাকতে পারো না।
জ্যাকুলিন, তুমি দেখবে সমুদ্র ভ্রমণে গিয়ে
ব্যালকনি দেখে কেমন বাঁচতে আচ্ছে করে
যেঘ দেখতে দেখতে হায় যায় লতাপাতার মতো কাছাকাছি
তুমি কখনো পিকনিকে গেলে দেখবে নারীপুরুষের
পাশাপাশি সুখ ও ভালোবাসার অবস্থান
টকিহল, মন্ত্রীদের বসভবন কিংবা হোয়াইট হাউসের
পাশ দিয়ে যেতে যেতে
তুমি এসব দেখে অযথা দুঃখ পাবে
তোমার অনেক কিছু আচ্ছে করবে জ্যাকুলিন,
ভালোবাসা, সুখ, চুম্বন এরকম আরো কতো কি
ও তুমি সইতে পারবে না ;
তোমার চোখের নিচে ভালোবাসার ধারালো রেজার
তোমার বুকের মধ্যে সুখী দম্পতির সবুজ ভূস্বর্গ
তোমার কোনো দোষ নেই জ্যাকুলিন, তোমার কোনো দোষ নেই
তুমি তো নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে
পারো না।

তুমি

একবার এক রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে
একটি ট্রেনের জানালায় তোমাকে দেখেছিলাম—
গায়ে পশমি-চাদর, চোখে হালকা-রঙের সানগ্লাস
তোমার সমুদ্রের মতো গভীর দৃষ্টি—
হয়তো বা আমার দিকেই!
মনে হলো, তুমি ইশারায় ডাকছো আমাকে।
আমার চোখ দু’টো জানালায় স্থির,
পৃথিবীর সব কোলাহল
অকস্মাৎ আফ্রিকার নির্জন বনভূমি হয়ে গেলো;
সব মানুষ এখন অপার স্তব্ধতায় নির্বাক।
এখানে আর কোনোদিন গার্ডের হুঁইসেল বাজবে না
প্ল্যাটফর্মের কাউন্টার থেকে
কোনোদিন বিক্রি হবে না কোনো টিকিট
যাত্রীরা লাগেজসহ ফিরে যাবে যার-যার ঘরে;
শুধু লাইনে দাঁড়ানো একটিমাত্র ট্রেন আমার চোখের সামনে
চিরকালের জন্যে অপেক্ষা করবে;
শুধু তুমি ছাড়া ট্রেনের সব কামরা থেকে
সকলেই একে-একে নেমে যাবে এখানে-ওখানে।
আর আমি বিশ্বজয়ী কোনো এক সম্রাটের মতো
একটি কবোষ্ণ ঠোঁটে
খুব সজোরে চেপে ধরবো আমার এই তৃষ্ণার্ত ঠোঁট;
আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরবো চুম্বকের মতো।
চতুর্দিকে অন্ধকার নেমে আসবে
সারা পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে
কিন্তু আমরা আমাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই ঠোঁট
পরস্পর চেপে রাখবো ততোদিন
যতোদিন না আমাদের যৌবন শেষ হয়ে যায়!

অথচ ইস্পাতের অনেকগুলো চাকায়
আমার একটিমাত্র বাসনা মাড়াতে-মাড়াতেই
তুমি কী অনায়াসে সুদূরের দিকে চলে গেলো!

তবে সেদিন, কেন তুমি ও-রকম সাড়া দিয়েছিলে?

স্পর্শ

তোমার শরীরে হাত আকাশ নীলিমা স্পর্শ করে
ভূমণ্ডল ছেয়ে যায় মধ্যরাতে বৃষ্টির মতন
মুহূর্তে মিলায় দুঃখ, দুঃখ আমাকে মিলায়
জলের অতল থেকে জেগে ওঠে মগ্ন চরাচর
দেশ হয় দেশ, নদী হয় পূনর্বার নদী
নৈঃশব্দ্য নিরুণ হাতে করতালি দেয়
নিসর্গ উন্মুক্ত করে সারাদেহে নগ্ন শরীর
কোন খানে রাখি তুলে দেহের বিস্তার
তোমার শরীরে হাত দীর্ঘতর আমার শরীর;
তোমার শরীরে হাত সূর্যোদয়, মেঘে রৌদ্র
জন্মান্তর আমার আবার;

তোমার শরীরে হাত একদিন, এই জন্মে শুধু একবার!

শহরে, এই বৃষ্টিতে

ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না
এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর
এই বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হিমে তোমার কোমল দেহের আদল
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে গেও না। মাধবী তুষারপাতে
বাইরে যেও না।

এ শহরে বৃষ্টি এলে আমি ভেসে যাই কান্নার করুণ ভেলায়
হাতে নিয়ে তোমার একদা দেয়া উপহারের গোপন অ্যালবাম
এই তুষর বৃষ্টিতে যদি সব ছবি মুছে গিয়ে লেগে থাকে জলের গভীর চিহ্ন
শুধু জল, আমার কান্নার মতো করুণ কোমল সেই জল,
সেই তুষারের দাগ
আমি যদি ভেসে যাই এমনি অথই তুষারজলে তুমি তবু নিরাপদে থাবো
সেই হৃদয়ের হৃতরাজ্যে কোনোদিন আর ফিরে যাবো না, যাবো না
সেখানে প্রত্যহ এক আততায়ী যুবকের বহুবিধ কঠিন শসন ;

শহরে বৃষ্টি এলে গলে গলে পড়ে সব ময়লা কফ বিভিন্ন অসুখ
শোকের তুষার জলে বড়ো ভয়, মাধবী তুমি তাই বাইরে এসো না
সেই ভালো আমার জীবনে তুমি সুবিখ্যাত কিংবদন্তী হয়ে থাকো আজ।

মৃত্যু ৫

কেউ তো আসেনি কাছে, কেউ তো দেয়নি মুখে একবিন্দু জল,
কেউ তো বলেনি ডেকে, ‘এখন কেমন আছো?’ শুধু অবিরল
চোখ বেয়ে নেমে গেছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুকণা, আর চোখে ঘুম,
শূন্য থেকে নেমে এসে আমাকে দিয়েছে শাস্তি, দিয়েছে হুকুম :
আর কটা দিন থাকো, তারপর আমি এসে নিয়ে যাবো যেখানে নেবার,
এখনো হয়নি কিছু, শুধু কিছু বাকি আছে সাক্ষ্য দেবার।

তারপর তোকে আমি শান্তি দেবো, চিরজীবনের মতো শান্তি পাবি তুই,
এবার ঘুমিয়ে পড়্, আমিও দু’চোখ বুজে তোর কাছে শুই।
তারপর শেষরাতে একদিন চার কাঁধে আমরাই নিয়ে যাবো তোকে,
কাঁদবে মানুষ,আর কাঁদবে প্রেয়সী তোর,সন্তানেরা কাঁদবে খুব শোকে।
তবুও যেতেই হবে, মানুষের এই তো নিয়তি আর এই তো সে-গান,
সময় হলেই তবে দেহ থেকে উড়ে যাবে পাখির পরান।

পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত

কাল রাতে ওরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছে
আমাকে ওরা এক নিঃসঙ্গ অন্ধকার রাতের থমথমে নিস্তব্ধতার মধ্যে
বেঁধে রেখে বলেছে, ‘শাট আপ। কথা বললেই গুলি করব!’

তখনই সমস্ত পৃথিবী কাঁপিয়ে, সমস্ত চরাচর, বনভূমি কাঁপিয়ে
একটা ভয়ানক হাহাকার, মৃতদের কলরোল উড়ে এসে
আমার বুকের কাছে আছড়ে পড়েছে;
আমি কেঁপে উঠেছি।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার মায়ের মুখ
একটি নিঃসঙ্গ একাকী প্রদীপের নিচে বেদনায় নুয়ে থাকা
আমার জন্মদাত্রীর এলায়িত দেহের ভঙ্গিমা
চৌকাঠে এলোমেলো বাতাসের আঘাতে উদাসীন
আমার প্রিয়তমা, আমার সন্তান, আমার একমাত্র উত্তরাধিকার।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমার রক্তের ভেতরে জেগে উঠেছে
এক পরাজিত সৈনিকের আহত, ক্ষতবিক্ষত, ক্লান্ত-দেহের
অস্বাভাবিক স্থবিরতা।

অথচ আমাকে থামলে চলবে না।
আমার সামনে কোটি কোটি মানুষের গগনবিদারী চিৎকার
আমার সামনে বিস্তৃত দিগন্তের নিচে অনাবিল সবুজ ধানের ক্ষেত
আমার সামনে পাকা ধানের মতো জীবনের
অবিরত সম্ভাবনার সোনালী ভাঁড়ার

আমার চোখে জল নেমে আসে।
আমি অনেকদিন অসম্ভব বৃষ্টির বিপুল জ্যোৎস্নার মধ্যে
শিশুর মতো খেলতে পারি নি
দুরন্ত বলের মতো সহস্র স্বপ্নের মধ্যে আমার নিবিড় প্রেম
অশ্ব হয়ে ছুটতে পারে নি কোনোদিকে
শুধু রক্তলাল এ জীবন বহতা নদীর মতো
প্রয়োজনে ছুটে গেছে দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের দিকে।
বুকের ভিতরে জেগে উঠেছে শতাব্দীর নীল আর্তনাদ
জেগে উঠেছে শোষণের সহস্র কাহিনী

শৃঙ্খলিত জীবনের মর্মঘাতী অতীত যাতনা।
সাথে সাথে আমার শিথিল হাত
জড়াতে জড়াতে মুুষ্টিবদ্ধ ইস্পাতে পরিণত হয়েছে
আমার কম্পিত করতলে ঘেমে উঠেছে শতাব্দী-লাঞ্ছিত মানুষের
এক অসম্ভব উজ্জ্বল রাসায়নিক বাল্ব।
আমি এক্ষুণি আমার বাল্ব ছুঁড়ে দেব
আজ কোন পরিত্রাণ নেই
কাল রাতে তোমরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছ
আজ তার প্রতিশোধ
এক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে তোমাদের এক-একটা জীবনকে
আমি আমার স্বপ্নের আঘাতে ভেঙে টুকরো করে দেব।
আমার বুকের ভিতরে এক নিঃশংসয় নগরীর প্রজ্বলিত আভা
আমার বুকের ভিতরে একটি সমান পৃথিবীর সবুজ মানচিত্র
আমি এখন ইচ্ছে করলেই সমস্ত পৃথিবীকে
আমার হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি,
শুধু প্রয়োজন প্রতিটি ঐতিহাসিক রক্তবিন্দুর কাছ থেকে
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস জেনে নেওয়া
আমি সেই রক্তবিন্দু থেকে সম্মুখের ইতিহাস অবধি
নিজের রক্তবিন্দুকে প্রবাহিত করে দিতে চাই
আমি একটি রক্তপাতহীন পৃথিবীর জন্যে
এই মুহূর্তে পৃথিবীর
মর্মঘাতী রক্তপাত করে যেতে চাই।

দুঃখ আছে কতো রকম

হায় আমাদের দুঃখ আছে কতো রকম
বুকের ক্ষত, মনের বারো গাঢ় জখম
মা যেমন দুঃখ করেন হলো না তার ঘটিবাটি সোনার বাসন
ন্যায্য আসন
ছেলেরা তার দিলো না কেউ
রইলো পড়ে বাইরে যেমন উড়োনচন্ডী
জোয়ারে ঢেউ ;
ঘর হলো না, নিজের কোনো ঠাঁই হলো না পায়ে দাঁড়াবার
হত বাড়াবার
বিপদ আপদ কতোই আছে
মা রাখলেন মনেই চেপে মনের দুঃখ
মনের কাছে,
আমি যেমন দুঃখ করি
দুঃখ করি
অনেক কিছু
ঠিক য়ে আমি চুটলি কখন কিসের পিছু
তাই জানি না
শীতের দিনে হাত বাড়িয়েও ঘরে একটু রোদ আনি না
কেন যে ঠিক দুঃখ করি তাই জানি না ;
এই তো আমি ইচ্ছে করলে খেতে পারি, ঘুমোতে পাই যখন তখন
অসুখ হলে কিনতে পারি অ্যাসপ্রো কিংবা চোখের জন্যে
দামী লোশন
বাসে চড়ে ঘুরতে পারি এখান থেকে অনেক খানি,
কিংবা যেমন কারো কারো প্রেমের জন্য প্যানপ্যানানি
প্রেম হলো না, হলো না ঠিক আলাপ কোনো মেয়ের সাথে
দিনেরাতে
বাদশাজাদীর তসবী নিয়ে নরম বিলাস
ও-সব ছাই নেই কিছুরই কোনো আভাস
আমার মধ্যে, তবু আমি দুঃখ করি
কিসের জন্যে দুঃখ করি তাই জানি না
গাই বিয়োবার আশায় ঘরে ধান ভানি না
সবাই আমরা দুঃখ করি একটা কিছুর দুঃখ করি
ঘটিবাটি, বসতবাড়ি, ফুলদানি বা সোনার বাসন
নিজের জন্য হলো না ঠিক যোগ্য আসন
হাত বাড়াবার শক্ত লাঠি
পরিপাটি সোনার জীবন
হলো না ঠিক যেমনটি চাই দুঃখ করি
সবাই আমরা একটা কিছু দুঃখ করি
কেন যে ঠিক দুঃখ করি তাই জানি না
কেবল বুঝি বুকের নিচে সুনীল জখম।

তোমার মুখের মতো চাঁদ

অকস্মাৎ কাল রাতে মরে গেছে পূর্ণিমার চাঁদ।
আকাশের কোথাও নক্ষত্রেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই,
পৃথিবীকে গ্রাস করেছে ভয়াল অন্ধকার—
তার বিশাল থাবায় হরিণের কোমল মাংসের মতো ঝুলে আছে
জ্যোৎস্নার আলো—বাতাসের ঘায়ে কেঁপে উঠে
লাফিয়ে পড়ছে অন্ধকারের ভেতরে—
যেন সমুদ্রের মধ্যে সজোরে নিক্ষিপ্ত
ক্ষুদ্রাকার একটি মাটির ঢেলা সামান্য আঘাত হেনে
মিলিয়ে গেলো অথৈ জলের নিচে।

আমার চোখ দু’টি বিস্ফারিত।
বেদনায় ক্রমশ নীল হয়ে উঠছে শিরা-উপশিরা।
বুকের ভেতরে ঘূর্ণিবাত্যার মতো জমে আছে গভীর বিষাদ;
একমাত্র অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে ভাসছে না।
কৃষ্ণসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে একটি ভোরের প্রতীক্ষায়
কেটে যাচ্ছে ব্যথিত প্রহর
ঠিক তখনই অন্ধকার ভেদ করে স্ফুরিত আলোর মতো
বেরিয়ে আসছে তোমার মুখ;
উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো সেই মুখ একটি তীব্র আলোকপিণ্ড হয়ে
পৃথিবীকে ভাসিয়ে দিচ্ছে আলোর বন্যায়;
চোখ-ধাঁধানো সেই আলোতে স্নিগ্ধ হয়ে উঠছে মাটি;
কৃষ্ণসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে
জ্যোৎস্নার আলোয় ভিজতে ভিজতে বারবার মনে হচ্ছে :

তোমার মুখের মতো এ রকম চাঁদ আমি এ জীবনে কখনো দেখিনি!

নিসর্গের খুন

এই প্রকৃতি একদিন আমাদের গ্রাস করবে
জিরাফের মতো গ্রীবা বড়িয়ে অকস্মাৎ,
কাঁঠালিচাপার বন, এই জ্যোৎস্নারাত
অমলিন নিসর্গের শোভা হানাদার দস্যুর মতো
ভয়ঙ্করভাবে ছুটে আসবে
আমাদের দিকে,অবরোধ করবে ঘরবাড়ি, শস্যের গোলা
খাদ্যভান্ডার লুট করে নিয়ে যাবে আমাদের মুখের গ্রাস
ভেঙে ফেলবে যাতায়াতযোগ্য স্থলপথ,
এই শান্ত চুপচাপ জলরাশি একদিন ধেয়ে আসবে আমাদের দিকে
নিশিডাকাতের মতো ডাক ছেড়ে হামলা করবে
চারদিক থেকে ঘিরে হত্যা করবে আমাদের ,
কেড়ে নেবে নগরকোটালের হাতের বাঁশি, বর্ম,
মাথার টুপি, শাদা পোশাক
সরল চাষার লণ্ডভণ্ড করবে খামার, শস্যক্ষেত
নিশিরাতে গোয়াল থেকে খেদিয়ে নেবে গরুর পাল
কালো খোঁয়াড়ে
বন্দী করবে একে একে,
লুটপাট করবে স্থানীয় মুদির দোকান, সারাগ্রাম
কাঠমিস্ত্রির সাজসরঞ্জাম তছনছ করবে,
জলের স্বেচ্ছাচার ছিনিয়ে নেবে গৃহবাসী ভালোবাসা
গোঁয়ার ট্রাকচালকদের মতো নিসর্গ আমাদের
একদিন ফেলে দেবে গভীর খাদে
যেখানে ধসে পড়বে আমাদের এই দিনরাত্রি
শক্ত প্রাচীর, বড়ো বড়ো অট্টালিকা
মহেঞ্জোদাড়োর মতো ধ্বংস হবে আমাদের নগরসভ্যতা
শাদা হাসপাতাল, পৌরসভা,
পার্ক ও খেলার মাঠ
বাঁধ ও সেতু ভেঙে আমাদের ভসিয়ে নেবে দুর্ধর্ষ প্লাবন,
আকাশ আমাদের বিরুদ্ধে একদিন ষড়যন্ত্র করবে
এই কাঁঠালিচাঁপার বন, জ্যোৎস্নারাত, পাখিডাকা নিসর্গ
সমুদ্রের বেলাভূমি সবাই,
এই আক্রমণকারী প্রকৃতির হাতে
একে একে ধ্বংস হবো আমরা
শিশু, বৃদ্ধ, যুবা
নিসর্গের প্লাবনে ভাসবো অন্তহীন লাশ!

আমলা-নামা

কিছু কিছু আমলা আছে
তাদের বড়ো গামলা আছে
তাতেই বহন করেন তারা মাল।
তাদের অনেক পাওয়ার আছে
অনেককিছু খাওয়ার আছে
কুমির এনে তারাই কাটেন খাল।
কেউ বা আবার খোদার খাসি
কেউ বা আবার বাঘের মাসি
কেউ বা আবার বিক্রি করেন দেশ।
কেউ বা আবার মিষ্টি হেসে
পাচার করেন সব বিদেশে
দেশটা তখন হয় যে পুরো শেষ।
আমলা নামক এই খুনিরা
লাঞ্ছনা দেয়, যে গুণীরা
জ্বালায় আলো সবার মনের মাঝে।
তাঁদের ওরা আঘাত করে
আগুন জ্বালায় তাঁদের ঘরে
তবু তারা বহাল থাকে কাজে।
যে আমলারা দেশপ্রেমিক
তারাই ঘোরে এদিক-ওদিক
পায় না তারা, তাদের যেটা ন্যায্য
তার বদলে ভাগ্যে জোটে
চাকরি থেকে রিজাইন মোটে
মন্ত্রী সাহেব তাদের করেন ত্যাজ্য।
ন্যায়ের বিচার পায় না তারা
মাথার উপর প্রবল খাড়া
পদোন্নতি হয় না তাদের ভাগ্যে।
এই কথা আর লিখবো কতো
সবাই বুঝুন নিজের মতো
লিখবো না আর দুখের কথা, থাক গে।

আমার এ-ভয় অন্যরকম

তোমরা সবাই ভয় পাও এই বাইরে যেতে
দুয়ার খুলে বাইরে যেতে
পথ পেরোতে
গাড়ির ভিড়ে বড়ো রাস্তা পার হতে যেই পা বাড়ালে
ভয় পাও এই আগুন দেখে
বারুদ দেখে
দোজখ দেখে ভীষণ রকম গজব দেখে খোদাতালার
তোমরা সবাই ভয় পাও এই দাঙ্গা দেখে
মড়ক লাগলে মহামারী এমনি কিছুর
ভয় পাও ঠিক রাত-বিরেতে অন্ধকারে
যাকে তাকে দেখলে হঠাৎ
হয় পাও এই সাপের বাঘের
চোর-ডাকাতের দৈত্যদানা জলপুলিশের
অনেক কিছুর ভয় তোমাদের
ভয় তোমাদের বাইরে কেবল চেখের ওপার,
আমার এ-ভয় অন্যরকম
অন্য কিছুর
আমার কিছুর
আমার এ-ভয় বাইরে তো নয়
ঘরের ভিতর নিজের ভিতর
আমার এ-ভয় নিজেকে ভয়
আমার এ-ভয় শোবার ঘরে বাথরুমটির
ঠাণ্ডা জলের টবের ভিতর
দাড়ি কাটার লম্বা ক্ষুরে
চায়ের কাপে কাঁটা-চামচে
আমার এ-ভয় আলমারিতে
বইয়ের তাকে ফুলদানিতে
মুখ দেখবার আয়না খুলে ড্রয়ার খুলে
আমার এ-ভয়
আমার এ-ভয় শত্রুকে নয় প্রিয়ার চোখে
নরম ঠোঁটে
নিজের দুটি করে মাঝে নখের ভিতর
আমার এ-ভয় অন্যরকম অন্যরকম।

কবি নামের চামচা

কবি নামের চামচা আছে
গলায় তাদের গামছা আছে
কবি আছে নানান রকমফের;
আমলা দেখে হাত কচলায়
তেল মারে আর মাছ খচলায়
দুই আনাতে কবি বিকোয় ঢের!
অকবিদের কবি বানায়
তাদের কি আর কবি মানায়?
দামড়া কিছু কবি আছে
তাদের বুকে ছবি আছে
বলতে পারো সে-সব ছবি কাদের?
গুলশানেতে বাড়ি আছে
সাপ্লাইয়ের নারী আছে
হরেকরকম মুখোশ আছে যাদের।
টাকার জোরে, মামার জোরে
দেশ-বিদেশে তারাই ঘোরে
উৎসবেতে তারাই যে হয় গণ্য;
কবিতা আর শিল্প তো নয়
ক্রমশ তা হচ্ছে যে ক্ষয়
কবি নামের অকবিদের জন্য!

এনজিওগ্রাম

বাইপাস দিয়ে নতুন রাস্তা ধরে ছুটে যেতে আমার খুব ভালো লাগে!
কিন্তু তার জন্যে সংযোগ-সড়ক চাই-
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এরকম ভাবতে-ভাবতে
যখন জানলাম, সংকীর্ণ পথের শেষপ্রান্তে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছে
রক্তকণিকার জমাটবাঁধা কিছু কেয়াকাঁটার ঝাড়-
তখন তাকে অপসারিত করার জন্য সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর মতো
যখন একা একা খুব দ্রুতবেগে ছুটে গেলো
স্প্রিংয়ের কেমিক্যালসজ্জিত কিছু স্বয়ংক্রিয় তার-
আমার চোখে নেমে এলো অসমাপ্ত ঘুম!
ঘুম ভাঙলে জানতে পারলাম, এরই মধ্যে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটে গেছে
কোলাহলমুখরিত হৃদয়ের আন্তরপ্রদেশে;!
২.৭৫ সেন্টিমিটার আকারের অপ্রতিরোধ্য ট্যাংকও তাকে
প্রতিহত করতে পারেনি কোথাও!
অন্ধকার রাত্রির বাইপাস পার হয়ে অবদমিত একটি হৃদয় শুধু ছুটে গেছে
মাধবীলতার বনে, অসংবৃত সুন্দরের কাছে!
বেসরকারি গ্রামে গ্রামে আগুনের হলকায় সরে গেছে
মৃত্যুর বাইপাসে ধাবমান আর একখানি তরল হৃদয়!!

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *