খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে নিহত চার, ১৪৪ ধারা জারি

■ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি প্রতিনিধি ■

পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। আজ শুক্রবার বেলা ১টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এটি জারি থাকবে বলে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। 

নিহত চারজন হলেন- খাগড়াছড়ির ধন রঞ্জন চাকমা (৫০), রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০) এবং রাঙামাটিতে একজন। এর মধ্যে ধন রঞ্জন চাকমার বাড়ি দিঘীনালায়। রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমার সদরের নারানখাইয়া এলাকায়। তবে রাঙামাটিতে নিহতের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

জেলা প্রশাসক বলছে, যেহেতু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে এবং জনগণের জান ও মাল ক্ষতি সাধনের আশঙ্কা রয়েছে। তাই আজ শুক্রবার বেলা ১টা থেকে রাঙামাটি জেলার পৌরসভা এলাকায় এবং বেলা ২টা থেকে খাগড়াছড়ি সদরে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৫৮ মোতাবেক ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত রাঙামাটি সদরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষের ঘটনায় একজন পাহাড়ি যুবক নিহত ও আহত হয়েছেন দুই পক্ষের ৫৫ জন।

খাগড়াছড়িতে বাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ এবং গুলিতে তিন পাহাড়ির মৃত্যুর প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে রাঙামাটির সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। জেলা সদরের বনরূপা, উত্তর কালিন্দীপুর, কালিন্দীপুর এবং বিজন সরণি এলাকার দেড় কিলোমিটারজুড়ে সংঘর্ষ চলে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাঙামাটিতে শুক্রবার বেলা একটা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

সংঘর্ষে নিহত যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাঁর মরদেহ রাঙামাটি সদর হাসপাতালে রয়েছে। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শওকত আকবর বলেন, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ৫৬ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে অজ্ঞাতপরিচয় একজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁর বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

আহতদের মধ্যে তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। ১৯ জনকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বাকিদের বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদের শরীরে জখম, পাথরের আঘাতসহ নানা ক্ষত রয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানান।

এর আগে সকাল ১০টার দিকে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি–বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে তিনজন পাহাড়ি নিহত হওয়ার প্রতিবাদে রাঙামাটির স্টেডিয়াম এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে পাহাড়ি ছাত্র জনতা। এতে কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়। স্টেডিয়াম থেকে মিছিলটি বনরূপা এলাকায় পৌঁছালে তাতে কে বা কারা পাথর নিক্ষেপ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে সংঘর্ষের জেরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতভর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। রাতের গোলাগুলি ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন পাহাড়ি নিহত হন। আহত হন অন্তত ১৫ জন। বুধবার মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মারধর করার ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আহত মামুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার বিকেল দীঘিনালায় পাহাড়িদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। তবে সেখানে কিছু বাঙালির দোকানও পুড়ে যায়।

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে নিহত চার, ১৪৪ ধারা জারি

খাগড়াছড়ি শহরে চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে বুধবার এক যুবক মারা যান। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতভর দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। আজ সকালে এই সহিংসতা রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। দুই জেলায় এ পর্যন্ত চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের অন্তত ৭০ জন। সংঘর্ষের সময় দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের গুজবকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সদরের বাঙালি অধ্যুষিত থানা বাজার ও বোয়ালখালী বাজারের বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিকেল ৪টার দিকে জনা পঞ্চাশেক বাঙালি মিছিল নিয়ে কলেজ গেট থেকে থানা বাজার ঘুরে লারমা স্কয়ারের দিকে এগোলে পাহাড়িরা বাধা দেয়। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলাকালে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা লারমা স্কয়ারে সওজের জায়গায় স্থাপিত অস্থায়ী মার্কেটে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ফাঁকা গুলির শব্দ হলে বাঙালিরা পিছু হটে।

সন্ধ্যার পর থেকে দীঘিনালা, পানছড়িসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার অবরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চড়াও হয়। পানছড়িতে বিক্ষোভকারীরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।

এদিকে আজ শুক্রবার সকালে রাঙামাটি শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে কয়েক হাজার পাহাড়ির একটি মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগ তুলে বাঙালিদের বেশ কিছু দোকানে হামলা চালানো হয়। এ সময় রাস্তায় চলাচলকারী বাস, ট্রাক, ট্যাক্সিতেও হামলা করা হয়। শহরের হ্যাপির মোড়কে কেন্দ্র করে এর দুদিকে অবস্থান নেন পাহাড়ি ও বাঙালিরা।

সকাল থেকে রাঙামাটিতে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনার পর পৌর এলাকায় বেলা ১টা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান। তিনি বলেন, যেহেতু রাঙ্গামাটির পৌর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে এবং জনগণের জানমালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেই কারণে আজ দুপুর ১টা থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়ার পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। এই আদেশ না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, রাঙামাটিতে সকালে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি কাজ শুরু করেছে। খাগড়াছড়িতেও সতর্ক রয়েছে পুলিশ।

এদিকে আগুনে ফাইবার অপটিকের ক্যাবল পুড়ে যাওয়ায় শহরে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইয়েস নেটের পরিচালক মো. শাহীন।

বর্তমানে পাহাড়িদের মধ্যে আতঙ্ক ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দুই জেলার বিভিন্ন স্থানে উত্তেজিত পাহাড়ি লোকজন রাস্তায় গাছ কেটে এবং চেঙ্গী নদীর জন্য নির্মিত ব্লক ফেলে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। ফলে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এর আগে গত বুধবার ভোরে খাগড়াছড়ি শহরের নোয়াপাড়ায় চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামে এক যুবদল কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় বিএনপি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, এ ঘটনা নিয়ে বুধবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঙালি ও পাহাড়ি সম্প্রদায়ের বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে অনেকটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দীঘিনালায় সংঘাত ঘটানোর উসকানি দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

তবে কাদের মধ্যে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।

খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা জানান, গুরুতর আহত চারজনকে চট্টগ্রামে রেফার করা হয়েছে। আহতদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, পরিস্থিতি শান্ত করতে জেলাজুড়ে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলার দীঘিনালায় দুইপক্ষের বিরোধের জের ধরে লারমা স্কয়ারের বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তাতে ৫০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। আহত হন পাঁচজন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *