সুন্দরবনের আগুন ৩০ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে

:: বাগেরহাট প্রতিনিধি ::

সুন্দরবনে লাগা আগুন ৩০ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয় বলছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আগামী কয়েক দিন এখানে অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম চলমান রাখা হবে।

আগুন লাগার সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয়ে তদন্তের জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রোববার (৫ মে) বিকেলে সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার দীপংকর বরের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানায় মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় সুন্দরবন-পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া ক্যাম্পের বনাঞ্চলের আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। আগুন গাছের উপরে বা ডালপালায় বিস্তৃত হয়নি, শুধু মাটির উপরে বিক্ষিপ্তভাবে বিস্তৃত হয়েছে। ঘটনাস্থলে বন বিভাগের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট, নৌবাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সিপিজি, স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় জনগণ অগ্নিনির্বাপণে সহায়তা করছেন। এছাড়া বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারও অগ্নিনির্বাপণে উপর থেকে পানি ছিটিয়ে সহায়তা করেছে।

শনিবার (৪ মে) আনুমানিক দুপুর সাড়ে ৩টায় আগুন লাগার ঘটনা প্রথম উদঘাটিত হয়। আগুন লাগার ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে বন বিভাগের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানের লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছান। বন বিভাগের কর্মীরা স্থানীয় কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ, ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় চারপাশ থেকে ফায়ার লাইন কাটার কাজ শুরু করেন। কিন্তু ওই সময় ভাটার কারণে খালে পানি না থাকায় আগুনে পানি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে রাতেই বন বিভাগের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট ও পানি দেওয়ার মেশিন এনে সেটি রেডি করে পাইপ লাগিয়ে সেট করে রাখা হয়। আজ ভোর থেকে বন বিভাগের কর্মীরা, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় জনগণ, সিপিজি, সিএমসির লোকদের নিয়ে আগুন লাগার স্থানের চারদিকে ফায়ার লাইন কাটার পাশাপাশি পানি দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ পুরোদমে শুরু হয়।

আগুন লাগার স্থানের চারদিকে প্রায় ৫ একর জায়গাজুড়ে ফায়ার লাইন কেটে আগুন নেভানোর কাজ চলছে। তবে যেহেতু আগুন মাটির নিচ দিয়ে গাছের শিকড়ে বিস্তৃতি লাভ করছে, কাজেই সতর্কতার সঙ্গে আগুন নেভাতে হচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ সুন্দরবনের আগুন নির্বাপণ কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক তদারকি ও সমন্বয় করছেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অবহিত আছেন এবং তিনি নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। এ কর্মকাণ্ড সরেজমিনে তদারকি করতে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী সুন্দরবনের ঘটনাস্থলে গেছেন। তিনি এ বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি ও কর্মপন্থা বিষয়ে আজ রাত সাড়ে ৮টায় খুলনায় সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করবেন।

বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে নাগরিক নিউজকে বলেন, সুন্দরবনের আমুরবুনিয়া জঙ্গলের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নতুন করে আগুন আর ছড়ায়নি। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় বন বিভাগের ২ শতাধিক বনকর্মীসহ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, আনসার-ভিডিপি সদস্যরা আগুন নেভাতে কাজ করে। বিমানবাহিনীও আগুন নির্বাপণে অংশ নেয়।

প্রাথমিকভাবে বনের ৫/৬ একর বনভূমির লতাগুল্ম পুড়ে গেছে বলে সিএফ জানিয়েছেন। রোববার দুপুরে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালিদ হোসেন ও পুলিশ সুপার মো. আবুল হাসনাত খান  অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বন পরিদর্শন করেন।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মো. নুরুল করিম নাগরিক নিউজকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ও এতে বনের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

এর আগে শনিবার (৪ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি-সংলগ্ন বনাঞ্চলে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে বন বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারা মিলে বালতি ও কলসি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। 

অগ্নি নির্বাপণ কার্যক্রম সরেজমিনে তদারকি করতে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী সুন্দরবনের ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি ও কর্মপন্থা বিষয়ে রোববার রাত সাড়ে আটটায় খুলনায় সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করবেন।

সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবগুলোই ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন এলাকায়। এসব আগুনের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, বেশির ভাগ আগুন লেগেছে জেলে-মৌয়ালদের অসাবধানতায়। যদিও এ নিয়ে বনজীবীদের দ্বিমত আছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনে এবার আগুন জ্বলছে পূর্ব বন বিভাগের ভোলা নদী থেকে সোয়া দুই কিলোমিটার দূরে আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায়। এর আগের আগুনটি ছিল ২০২১ সালের মে মাসে পূর্ব সুন্দরবনে দাসের ভারানির পাশের অঞ্চলে। সব মিলিয়ে ২০০২ সাল থেকে গতকালের আগপর্যন্ত ঘটা ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত করেছে পূর্ব বন বিভাগ।

বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৪টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৩৩ টাকা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে প্রাণী বৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি ধরা হয় আনুমানিক হিসাবে। ফলে এই হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আসেনি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  

এ ছাড়া প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশে আগুনের সূত্রপাতের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, জেলে-মৌয়ালদের অসাবধানতায় আগুন। অর্থাৎ জেলে-মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকেই সবচেয়ে বেশি আগুনের সূত্রপাত হয়।

প্রতিবারই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। গতবার আগুনের ঘটনায়ও ‘কর্ডন’ বা ‘ফায়ার লাইন’ (আগুন নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখতে চারদিকে নির্দিষ্ট গভীরতায় ভূমি খনন) তৈরি করতে হিমশিম খেয়েছেন কর্মীরা। এবারের আগুনের ঘটনাস্থল লোকালয় থেকে দূরে বলে নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুস সোবহান মল্লিক গত ফেব্রুয়ারিতে একটি দল নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। ‘সমন্বিত বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার’ অংশ হিসেবে এই মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি রোববার দুপুরে বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত হলে প্রথম জরুরি কাজ ফায়ার লাইন তৈরি করা। এ কাজটি সবচেয়ে দ্রুত ও দক্ষভাবে করতে পারবেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই ফায়ার লাইন করতে তাঁদের সম্পৃক্ত করতে হবে।’

আবদুস সোবহান মল্লিক বলেন, ‘বনের ভেতর ছোট ছোট খাল থাকায় আমাদের অঞ্চলে সুন্দরবনে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কম। অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যায়, বড় গাছ অপেক্ষা ঝোপের মতো জায়গায় আগুন বেশি লাগে।’ আগুনে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক মাত্রা নিরূপণে জীববৈচিত্র্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী, সেটাও ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন আবদুস সোবহান মল্লিক।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *