:: আবু রায়হান ::
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ উপলক্ষ্যে মানস এর সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেছেন, নাটক, সিনেমা এবং তরুণদের কাছে অধিক জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজগুলোতে প্রধান চরিত্র দ্বারা ধূমপানের দৃশ্য প্রচার অপ্রাপ্তবয়স্কদের তামাকজাত দ্রব্য সেবনে প্ররোচিত করছে।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম শিশু-কিশোরদের ধূমপানে উৎসাহিত করার নতুন ফাঁদ। এর ফাঁদ তৈরিতে সিগারেট কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ক্ষতিকর নেশামুক্ত স্বাস্থ্যবান জাতি গড়তে নাটক, সিনেমা ও ওটিটি-তে ধূমপানের দৃশ্য বন্ধের দাবী জানিয়েছেন তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ও দেশের বিশিষ্টজনরা।
মঙ্গলবার (৩০ মে), সকাল ১১:০০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মানস’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ দাবী জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন ও সভাপতিত্ব করেন ‘মানস’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত, অভিনেত্রী রুমানা রশীদ ঈশিতা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নীতি বিশ্লেষক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মানস এর সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান তালুকদার ও সঞ্চালনা করেন তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প সমন্বয়কারী উম্মে জান্নাত।
উল্লেখ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘সাউথ ইস্ট এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালকের বিশেষ সম্মাননা’ লাভ করেছেন তিনি। দীর্ঘ ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে তামাক বিরোধী সচেতনতা তৈরীতে কাজ করছন ড. অরূপরতন চৌধুরী। গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, ৩০টির বেশি বই প্রকাশ, শতাধিক প্রবন্ধ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ, মানস সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ও নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে কাজ করছেন তিনি। সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ জাতীয় কমিটি ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের একজন সম্মানিত সদস্য ড. অরূপরতন।
প্রবন্ধে মানস এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, ধূমপায়ীদের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ হয় এবং বর্তমানে এসব রোগে ৬৭% মানুষ মারা যাচ্ছে। তারুণ্য নির্ভর জনগোষ্ঠির দেশ বাংলাদেশ। তরুণদের সিগারেটে আসক্ত করে দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তা বানাতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় নাটক, সিনেমা, ওয়েবসিরিজে প্রধান চরিত্র দ্বারা অযাচিতভাবে ধূমপান প্রদর্শন করে শিশু-কিশোর, তরুণদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। যা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের লঙ্ঘণ। আমাদের আগামী প্রজন্মের মধ্যে নতুন ধূমপায়ী তৈরী বন্ধ করতে হবে। এজন্য তামাক কোম্পানির প্রচার-প্রচারণা ও প্রলুব্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করা জরুরি।
এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, নাটক, সিনেমা, ওয়েবসিরিজে এমনভাবে ধূমপান প্রদর্শন করা হচ্ছে যেন এগুলো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। এর পেছনে তামাক কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা আছে। আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য তারা ফাঁদ তৈরী করছে। দেশে ওটিটি নীতিমালা হচ্ছে সেখানে ধূমপান বন্ধের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রাধান্য পাওয়া জরুরি বিষয়। বর্তমানে ঢাকায় প্রায় প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ করে দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। রেস্টুরেন্টে মানুষ পরিবার নিয়ে খাবার খেতে যায়, ভালো সময় কাটাতে যায়। অথচ, সেখানে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। সিগারেট কোম্পানির এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
রুমানা রশীদ ঈশিতা বলেন, আমাদের মুল ভাবনায় থাকেন শিশুরা। যারা আমাদের ভবিষ্যত। নতুন প্রজন্মকে তামাকে ক্ষতি জানাতে হবে, সচেতন করতে হবে। যারা পরিবার ও সমাজের আইডল, তাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। কারণ শিশু ও অল্পবয়সীরা বইয়ের চাইতে দেখে দেখে বেশি শিখে। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে বর্তমানে অনেক পণ্য সহজেই কেনা যায়। সিগারেট, ভেপ এর মতো ক্ষতিকর পণ্যও সব বয়সী মানুষ কিনছে অবাধে। কারণ শিশুদের হাতের নাগালে এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। আইনের বাস্তবায়নের জন্য সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি এখন বিশ^কে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে।
শ্যামল দত্ত বলেন, একটা সময় ছিলো যখন বিজ্ঞাপনের জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো তামাক কোম্পানি। ঐ সময়েও নীতিগত অবস্থান থেকে ধূমপানের বিজ্ঞাপন ছাপেনি ভোরের কাগজ। কারণ, ক্ষতিকর পণ্যের প্রচারণায় মানুষের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তামাক কোম্পানিগুলো নিজ দেশে সিগারেট ব্যবহার কমায়, আর বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। নতুন ভোক্তা তৈরীতে যত ধরনের অপতৎপরতা আছে সবই করছে তামাক কোম্পানিগুলো। নীতিগত অবস্থানেও তামাক কোম্পানি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে কারণ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে সরকারের সামান্য শেয়ার ও পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি রয়েছে। আমাদের আইনের ১৮ বছরের নীচে কারো কাছে তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ। সে আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যারা আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের সক্রিয়তা নেই।
উল্লেখ্য, তামাক বিরোধী সচেতনতার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ৩১মে তামাকমুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ বছরও “Protecting Children from Tobacco Industry Interference” প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবানুবাদ- “তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।” প্রদিপাদ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে মানস এর উদ্যোগে ৩১ মে, শুক্রবার, বিকাল ০৩:০০টায় উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে।