:: মারুফ কামাল খান ::
কোকো। মানে আরাফাত রহমান কোকো। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া দম্পতির কনিষ্ঠ পুত্র। খেলা-পাগল এবং একটু অন্তর্মুখী ও স্বল্পভাষী কোকোকে খুব কাছে থেকে দেখলেও তার সঙ্গে আমার খুব একটা ভাবসাব হয়নি। তা’ছাড়া রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যাপারে তার মধ্যে কখনো কোনো আগ্রহ বা কৌতূহল আমি লক্ষ্য করিনি।
ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন যামানায় গ্রেফতারের পরই বন্দী অবস্থায় কোকো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুক্তির পর তাকে দেশের বাইরেই কাটাতে হচ্ছিল চিকিৎসার জন্য। যখন আচানক মারা গেলেন কোকো তখন আমরা গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসে এক দুঃসহ সময় পার করছি।
২০১৪ সালের একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকীকে জনগণের ভোটাধিকার হরণের দিন হিসেবে পালনের জন্য বিএনপি পল্টনে দলীয় সদর দফতরের সামনে গণজমায়েত করার উদ্যোগ নেয়। তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে ম্যাডাম জিয়ার যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু আগের রাতেই গুলশান অফিসে তাকে আটকে দেয় পুলিস। কার্যালয় থেকে বেরুবার ফটক বন্ধ করে। পরের দিন বিকেলে সমাবেশে যাবার উদ্দেশ্যে ম্যাডাম জিয়া গাড়িতে উঠার সময় বাইরে থেকে পুলিস ভেতরে গেটের কাছে সমবেত সকলের ওপর ফটকের ওপর দিয়ে পিপার স্প্রে ছুঁড়ে মারে।
সে সময় থেকে ম্যাডাম জিয়াসহ আমাদের সকলকে ওই অফিসে তিন মাস ধরে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তখন আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক হরেক রকম সংগঠনের লোকজন প্রায় রোজ ওই অফিস ঘেরাওয়ের নামে হামলা চালাবার মহড়া করতো। নানান রকম হুমকি দিতো ও ভয়ভীতি দেখাতো। আর ম্যাডাম জিয়া সহ ভেতরে আটক আমাদের অনেকের বিরুদ্ধেই নিয়মিত বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় সহিংসতা চালাবার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের করা হচ্ছিল।
এ অবস্থায় মালয়েশিয়া থেকে কোকোর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ আসে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই মর্মান্তিক খবরটি ঘোষণার দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়। তারপর কোকোর লাশ এলো তার দুই কিশোরী কন্যা ও সদ্যবিধবা পত্নীর সঙ্গে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! কখনো ভোলার নয়। কোকোর লাশ দাফনের জন্য জায়গা বরাদ্দ নিয়েও এন্তার নোংরা নাটক করলো ক্ষমতাসীনেরা।
কিন্তু বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে কোকোর জানাজা ঘিরে পুরো এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হলো এক অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য। মানুষ আর মানুষ, লাখে লাখে মানুষ! শহীদ জিয়ার পর আর কারুর জানাজায় এতো বিপুল সংখ্যক লোকসমাগম হয়নি। মিথ্যা মামলা ও বৈরী প্রচারণার অসহায় শিকার হতভাগ্য একজন অরাজনৈতিক মানুষের জন্য কেন এতো মানুষের ঢল নেমেছিল সে এক অপার বিষ্ময়!
কোকো মারা যাবার পর আমাকে খুব নাড়া দেয় তাকে নিয়ে একটি লেখা। লেখিকা প্রবাসী বাংলাদেশী। তিনি একজন পেশাজীবী এবং সাহিত্যিক। বেশ ভালো লেখেন। রাজনীতি বা কোনো দলের সঙ্গে সংশ্রবহীন এই লেখিকার লেখাটিকে আমি সম্পূর্ণ স্বার্থহীন মনে করি। আমার বিশ্বাস, কোনো রকম উদ্দেশ্য ছাড়া, সম্পূর্ণ প্রাণের তাগিদে, নিরেট সত্য উচ্চারণের সততা থেকেই স্মৃতিচারণমূলক এ লেখা। কোকোর প্রতি দলের বাইরের মানুষের মনোভাব ও মূল্যায়ন এ লেখায় বিধৃত। আমার মনে হয়, একই মনোভাব তার জানাজায় আসা বিপুল জনস্রোতের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল।
কোকোর মৃত্যুর পরপরই এ লেখাটি আমি অফিসবন্দী থাকতেই ম্যাডাম জিয়াকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। শুনে সদ্য সন্তানহারা দুঃখিনী মায়ের হৃদয়ভাঙা বেদনার্ত যে অভিব্যক্তি হয়েছিল তা’ প্রকাশের উপযোগী ভাষা আমার আয়ত্বে নেই।
লেখক: সাংবাদিক