:: ফজলে এলাহী ::
৮০’র দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের অডিও গানে মুজিব পরদেশী নামের এক শিল্পী এসে তোলপাড় করে দিলো তাঁর কণ্ঠের ফোক গান দিয়ে। সেই মুজিব পরদেশী’কে আজকের প্রজন্ম পায়নি, তাঁর সম্পর্কে অনেকেই জানে না, তাঁর গান আজকের শ্রোতারা শুনেছেন কিন্তু জানেন না যে গানটির মূল শিল্পী ছিলেন মুজিব পরদেশী নামের এক অখ্যাত নতুন শিল্পী যিনি বাংলাদেশের সঙ্গীতে এসে রেকর্ড গড়লেন সর্বোচ্চ বিক্রিত অ্যালবাম দিয়ে। এখনও সেদিনের শ্রোতারা মুজিব পরদেশি’র কথা ভুলতে পারেননি। আজকের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘বাংলা’র আনুশেহ ও অর্ণব এর কণ্ঠে আপনারা যে ‘তুই যে আমার মন’ গানটি শুনেছেন সেই গানটির মূল শিল্পী ছিলেন মুজিব পরদেশী যা ছিল তাঁর ইতিহাস সৃষ্টি করা প্রথম অ্যালবাম ‘আমি বন্দী কারাগারে’র গান । আজ আপনাদের সেই হারিয়ে যাওয়া মুজিব পরদেশী নামের একটি নক্ষত্রের উত্থান-পতনের অজানা কিছু গল্প বলবো।
১৯৮৬ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর তারিখে মাত্র পৌনে ২ ঘণ্টায় ১১ টা রেকর্ড করে ফেললেন যা পরবর্তীতে হয়ে যায় একটি ইতিহাস । পুরো অ্যালবাম তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ১৩৬০ টাকা যা বিক্রি হয়েছিল ৬০ লাখ কপি (মূল কোম্পানির) আর নকল করে আরও প্রায় ২৫/৩০ লাখ কপি যা হয়ে গেলো অডিও ইন্ডাস্ট্রির সর্বাধিক বিক্রীত ক্যাসেটের রেকর্ড। বাংলাদেশের এমন কোন শ্রোতা পাওয়া যায়নি তখন যার ঘরে এই অ্যালবামটি ছিল না। শহর, বন্দর, গ্রাম গঞ্জের সবখানে মুজিব পরদেশীর ‘আমি বন্দী কারাগারে’ অ্যালবামটি বাজতে থাকলো। শুধু কি অডিও ক্যাসেটে? না, সেই অ্যালবামের ১১ টি গান ১১ টি চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়েছিল। তার মাঝে তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবিতে ‘আমি বন্দী কারাগারে’ গানটি এমনই হিট করলো যে ছবিটি হয়ে গেলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ব্যবসাসফল রেকর্ড গড়া ছবি। এভাবেই মুজিব পরদেশী হয়ে গেলেন ফোক গানে বাংলাদেশের শ্রোতাদের খুব জনপ্রিয় একটি নাম।
মুজিব পরদেশীর জন্মস্থান নিয়ে অনেক তথ্য আছে কেউ বলে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি কেউ বলে বিক্রমপুর। তবে সঠিক তথ্য হলো মুজিব পরদেশী হলেন বিক্রমপুরের বাসিন্দা যাকে এই অডিও জগতে এনেছিলেন ফোক গানের জনপ্রিয় গীতিকার ও অডিও প্রযোজক হাসান মতিউর রহমান যিনি ছিলেন ‘চেনাসুর’ অডিও কোম্পানির কর্ণধার। ১৯৮৬ সালের কথা। গীতিকার হাসান মতিউর রহমান একজন শিল্পী খুঁজছেন যিনি পংকজ উদাসের মতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গজল গাইতে পারে এমন কাউকে। তখন মুজিব পরদেশী তাঁর বাবার ফলের দোকানে কাজ করেন আর অবসরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান করেন। এভাবে একদিন হাসান মতিউর রহমানও মুজিব পরদেশীর গান শোনলেন রাস্তায়। সেই শোনার পর থেকে মুজিব পরদেশীর কণ্ঠটি তাঁর কানে বাজতে বাজতে থাকে। অনেক কষ্টে ঠিকানা যোগাড় করে হাসান মতিউর রহমান ওয়াইজ ঘাটে গেলেন মুজিবের বাবার ফলের দোকানে। গিয়ে দেখলেন দোকানে সে যোগালি করছে । তখনও তাঁর নাম মুজিবুর রহমান মোল্লা। হাসান মতিউর রহমান মুজিবকে ক্যাসেট বের করার প্রস্তাব দিলেন একটু ঘুরিয়ে যেন বেঁকে না বসে ও কোন দাবী দাওয়া না করে।
হাসান মতিউর রহমানের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে মুজিবুর রহমান মোল্লা একটি অডিও ক্যাসেট বের করতে এলেন। হাসান মতিউর রহমান মুজিবুর রহমান মোল্লা নামটির বদলে ছোট করে নাম রাখলেন মুজিব সাথে যোগ করলেন ‘পরদেশী’ শব্দটা কারণ তখন চলচ্চিত্রে বিক্রমপুরের একজন অভিনেতা ছিলেন যার নাম ছিল মুজিব বঙ্গবাসী সেই নামের সাথে মিল রেখেই নামটা রাখা হয়। এভাবে হাসান মতিউর রহমানের হাতে জন্ম নিলো একজন নতুন শিল্পী মুজিব পরদেশী। হাসান মতিউর রহমান চাইলেন পঙ্কজ উদাসের মতো হারমোনিয়াম এর তালে গজল সঙ্গীত কিন্তু মুজিব পরদেশী চাইলেন জীবনের প্রথম অ্যালবাম যেন সব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হোক। মুজিব পরদেশী হাসান মতিউর রহমানকে বাদ্যযন্ত্রের জন্য ৫০০০ টাকা দিলেন। কিন্তু হাসান মতিউর রহমান অনড় রইলেন। হারমোনিয়াম বাজানোর জন্য ঠিক করলেন নকুল কুমার বিশ্বাসকে কিন্তু নকুল ক্লাসিক বেইজে ভালো বাজালেও ফোক বেইজে ভালো বাজাচ্ছিল না। নকুল কুমার বাদ পড়লেন মুজিব পরদেশী হাসান মতিউরের অনুমতি নিয়ে ৫/৬ এর জন্য হারমোনিয়ামটা নিলেন বাসায় নিজে একটু চেষ্টা করে দেখবেন বলে। ৫/৬ দিন পর মুজিব পরদেশী এলেন আর গানগুলো তুলে শোনালেন যা শুনে হাসান মতিউর রহমান বিস্মিত হয়ে গেলেন। হারমোনিয়ামের সাথে পরিচিত এক ছেলেকে দিয়ে মন্দিরা বাজালেন । ব্যস হয়ে গেলো পাগল করা সব গান। মুজিব পরদেশী অ্যালবামে যে হারমোনিয়ামটা ব্যবহার করেছিলেন সেটা হাসান মতিউর রহমান কিনে এনেছিলেন ৭০ টাকা দিয়ে শাঁখারিবাজার থেকে কিনেছিলেন যা ছিল পুরনো একটি জুরি হারমোনিয়াম। পুরনো হলেও এর আওয়াজটা ছিল দারুন যার কারণেই এটি কেনা হয়।
১৯৮৬ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর তারিখে মাত্র পৌনে ২ ঘণ্টায় ১১ টা রেকর্ড করে ফেললেন যা পরবর্তীতে হয়ে যায় একটি ইতিহাস। পুরো অ্যালবাম তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ১৩৬০ টাকা যা বিক্রি হয়েছিল ৬০ লাখ কপি (মূল কোম্পানির) আর নকল করে আরও প্রায় ২৫/৩০ লাখ কপি যা হয়ে গেলো অডিও ইন্ডাস্ট্রির সর্বাধিক বিক্রীত ক্যাসেটের রেকর্ড। বাংলাদেশের এমন কোন শ্রোতা পাওয়া যায়নি তখন যার ঘরে এই অ্যালবামটি ছিল না। শহর, বন্দর, গ্রামগঞ্জের সবখানে মুজিব পরদেশীর ‘আমি বন্দী কারাগারে’ অ্যালবামটি বাজতে থাকলো। শুধু কি অডিও ক্যাসেটে? না, সেই অ্যালবামের ১১ টি গান ১১ টি চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়েছিল । তার মাঝে তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবিতে ‘আমি বন্দী কারাগারে’ গানটি এমনই হিট করলো যে ছবিটি হয়ে গেলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ব্যবসাসফল রেকর্ড গড়া ছবি। এভাবেই মুজিব পরদেশী হয়ে গেলেন ফোক গানে বাংলাদেশের শ্রোতাদের খুব জনপ্রিয় একটি নাম।
মুজিব পরদেশী যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখনই ঘটে ছন্দপতন । লন্ডনে গেলেন একটি শো করার জন্য। সেখানে গিয়ে আয়োজকদের পরামর্শে রয়ে গেলেন বেশ কিছুদিন। ৪ মাসের ভিজিট ভিসা শেষ হওয়ার পরেও আরও কিছুদিন রয়ে যান এবং একসময় দেশে ফিরে আসেন। লন্ডনে থাকাবস্থায় আদম পাচারের মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়েন মুজিব পরদেশী। দেশে ফিরে এসে লন্ডনে লোক নিবেন বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে নুরুল ইসলাম নামের পরিচিত এক ব্যক্তিকে দিলেন যিনি ছিলেন বাংলাদেশে ঐ মাফিয়া চক্রের সদস্য। সবটাকা মেরে নুরুল ইসলাম আত্মগোপন করলে মুজিব পরদেশীর উপর পাওনাদারেরা টাকার চাপ দিতে থাকে। কিন্তু মুজিব পরদেশী সব টাকা তো না বুঝেই চক্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। যার ফলে পাওনাদারেরা টাকা না পেয়ে মুজিব পরদেশীর নামে মামলা করলেন । মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন এবং একসময় জামিনে বের হয়ে এলেন। জামিনে বের হওয়ার পর থেকে আর কখনও মামলায় হাজিরা দেননি, সেই থেকে অনেকদিন পলাতক ছিলেন, কিছুদিন আগে টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিলো।
চমৎকার লেখা