:: ক্রীড়া প্রতিবেদন ::
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ১২তম ম্যাচে এসে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেটের ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এর আগে একটি মাত্র টেস্ট জিতেছিলো বাংলাদেশ। ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টিতে জয় ছিল না। নেপিয়ারে আগের ম্যাচেই ওয়ানডে ইতিহাসে কিউইদের বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে প্রথম জয়ের স্বাদ নিতে পেরেছিলো নাজমুল হোসেন শান্তর দল। এবার টি-টোয়েন্টিতেও সেই অপেক্ষার অবসান হলো।
বুধবার নেপিয়ারে উইকেটের সুবিধা নিতে টস জিতে বোলিং নেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। ১ রানে স্বাগতিকদের ৩ উইকেট তুলে নেন শরিফুল ও শেখ মাহেদী। কিউইরা ৯.২ ওভারে ৫০ রানে হারায় ৫ উইকেট। সেখান থেকে অলরাউন্ডার জেমি নিশাম ও মিশেল স্যান্টনার দলকে ৯ উইকেটে ১৩৪ রানের পুঁজি এনে দেন।
দলটির হয়ে তিনে নামা ড্যারেল মিশেল ১৪ রান করেন। নিশাম ২৯ বলে খেলেন ৪৮ রানের ইনিংস। তার ব্যাট থেকে চারটি চারের সঙ্গে আসে তিনটি ছক্কার শট। স্যান্টনার ২২ বলে ২৩ রান যোগ করেন। এছাড়া এডাম মিলনে ১৬ রান করে অপরাজিত থাকেন।
বাংলাদেশ দলের হয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন শরিফুল ইসলাম, মুস্তাফিজুর রহমান ও মাহেদী। শরিফুল ৪ ওভারে ২৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন। ক্যাচ না ফেললে উইকেট বাড়তো তার। মুস্তাফিজ ৪ ওভারে মাত্র ১৫ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়েছেন। মাহেদীর ৪ ওভার থেকে মাত্র ১৪ রান নিতে পারে কিউইরা। তাকে উইকেট দেয় দুটি। লেগ স্পিনার রিশাদ ৩ ওভারে ২৪ রান দিয়ে নেন এক উইকেট। তবে পেসার তানজিম সাকিব ৪ ওভারে ৪৫ রান হজম করেন।
১৩৫ রানের লক্ষ্যে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার লিটন দাস ও রনি তালুকদার। ইনিংসের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে টিম সাউদিকে কাভারের ওপর দিয়ে ছক্কা মারেন রনি। তবে দ্বিতীয় ওভারেই ভেঙে যায় বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি। দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলে অ্যাডাম মিলনেকে পুল করতে যান রনি। টপ এজ হওয়া বল মিড অনে তালুবন্দী করেছেন সাউদি। ৭ বলে ১ ছক্কায় ১০ রান করেন রনি। বাংলাদেশের স্কোর হয়ে যায় ১.৪ ওভারে ১ উইকেটে ১৩ রান।
রনি আউট হওয়ার পর তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। একের পর এক বাউন্ডারি মারছিলেন তিনি। পঞ্চম ওভারের পঞ্চম বলে জিমি নিশামকে দুর্দান্ত স্ট্রেইট ড্রাইভে চার মারেন শান্ত। ঠিক তার পরের বলে আবারও চার মারতে যান শান্ত। টাইমিংয়ে গড়বড় করা বাংলাদেশ অধিনায়ক মিড অফে ক্যাচ তুলে দেন মিচেল স্যান্টনারের হাতে। ১৪ বলে ৪ চারে ১৯ রান করেন শান্ত। বাংলাদেশের স্কোর হয়ে যায় ৫ ওভারে ২ উইকেটে ৩৮ রান । এরপর চার নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমেছেন সৌম্য সরকার। সপ্তম ওভারের প্রথম বলে ইশ সোধিকে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে বিশাল ছক্কা মারেন সৌম্য। পরের বলে উল্টো দিকে ঘুরে শট খেলেন সৌম্য। বাংলাদেশের বাঁহাতি ব্যাটারের সুইচ হিটে শর্ট থার্ড ম্যানের ওপর দিয়ে হয়ে যায় চার।
তবে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে থাকা সৌম্যও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। নবম ওভারের চতুর্থ বলে বাংলাদেশের বাঁহাতি ব্যাটার বোল্ড হয়েছেন বেন সিয়ার্সের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। তাতে ৮.৪ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর হয়ে যায় ৩ উইকেটে ৬৭ রানে। এরপর পাঁচ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামেন তাওহীদ হৃদয়। হৃদয়কে নিয়ে লিটন বেশ সাবলীলভাবেই এগোতে থাকেন। চতুর্থ উইকেটে ২৯ বলে ২৯ রানের জুটি গড়েন লিটন-হৃদয়। হৃদয়কে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন স্যান্টনার। কাভার ড্রাইভ করতে গিয়ে হৃদয় ধরা পড়েন শর্ট এক্সট্রা কাভারে সাউদির হাতে। ১৮ বলে ১ ছক্কায় হৃদয় করেন ১৯ রান।
হৃদয়ের পর উইকেটে এসে দ্রুত আউট হয়েছেন আফিফ হোসেন। সাউদির শর্ট বল পুল করতে যান আফিফ। মিড উইকেটে সহজ ক্যাচ ধরেন জেমস নিশাম। হৃদয়, আফিফের দ্রুত বিদায়ে বাংলাদেশের স্কোর হয়ে যায় ১৪.৩ ওভারে ৫ উইকেটে ৯৭ রান। একই ওভারে বাংলাদেশ হারাতে পারত ষষ্ঠ উইকেট। লিটনের বিপক্ষে সাউদি এলবিডব্লু আবেদন করলে আম্পায়ার আউট ঘোষণা করেন। রিভিউ নিলে দেখা যায়, বল স্টাম্পের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাতে বেঁচে যান লিটন।
বেঁচে যাওয়ার পর লিটন এগোতে থাকেন সাবলীলভাবে। ১৮তম ওভারের প্রথম বলে সাউদিকে মিড অফ দিয়ে চার মারেন লিটন। পরের বলে স্কুপ করে ফাইন লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা মারেন বাংলাদেশের এই ব্যাটার। এই ছক্কা নিয়ে হয়েছে একটু নাটকীয়তা। প্রথমে ফাইন লেগে ক্যাচ ধরেন ইশ সোধি। তবে দ্রুতই সীমানার দড়িতে পা দিয়ে ফেলায় তা হয়ে যায় ছক্কা। বলতে গেলে এই ওভারেই ম্যাচ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নেয় বাংলাদেশ। বাকি ৪ বলে ৪ রান নিলে শেষ ২ ওভারে বাংলাদেশের দরকার হয় ১০ রান।
হাতে ৫ উইকেটে ২ ওভারে ১০ রানের সহজ সমীকরণ দ্রুতই মিলিয়েছেন শেখ মাহেদী হাসান। ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে কাভারের ওপর দিয়ে ছক্কা মারেন মেহেদি। পরের বলে নিয়েছেন ২ রান। এরপর চতুর্থ বলে মিড অফ দিয়ে চার মেরে মাহেদী বাংলাদেশকে এনে দেন ঐতিহাসিক এক জয়। ৮ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটের জয়ে চক্রপূরণ করেছে বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি-তিন সংস্করণেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে ঐতিহাসিক জয়ে ম্যাচসেরা হয়েছেন শেখ মাহেদি। ৪ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়েছেন। ব্যাটিংয়ে ১৬ বলে ১ চার ও ১ ছক্কায় ১৯ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডের হয়ে সাউদি, মিলনে, নিশাম, বেন সিয়ার্স ও স্যান্টনার একটি করে উইকেট নিয়েছেন। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ আগামী ২৯ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে মাঠে গড়াবে।
ম্যাচ শেষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে আসা নিশাম বলেন, ব্যাটিং–ব্যর্থতাই তাদের হারের কারণ, ‘আমাদের উইকেট পড়ার সময়টা ভালো ছিল না। বিশেষ করে যখনই মোমেন্টাম পাচ্ছিলাম, তখনই উইকেট গেছে। আমি নিজেও অসময়ে আউট হয়েছি। এই ফল হজম করাটা কঠিনই।’
বাংলাদেশ দলের দারুণ কিছু করার তাড়না ছিল বলে মনে করেন নিশাম, ‘বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিতেই হবে। তারা ম্যাচের শুরু থেকেই খুবই প্যাশনেট ছিল। কিছু মোমেন্টামও পেয়েছে। আমাদের জন্য এটা আরেকটা দিন, যখন আরও ১৫-২০ রান বেশি করতে পারলে ম্যাচের চিত্রটা ভিন্ন হতে পারত। তবে তারা ভালো খেলেছে। জয়টা তাদের প্রাপ্য।’
নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টির আগে তৃতীয় ওয়ানডেতেও হেরেছিল নিউজিল্যান্ড। দুটি ম্যাচেই বোলিংয়ের তুলনায় ব্যাটিংয়ে বেশি ভুগেছে তারা। শরীফুল-মোস্তাফিজ-তানজিমদের প্রশংসাই ঝরেছে নিশামের কণ্ঠে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ এমন ভালো মানের কিছু পেসার পেয়েছে, যাদের নিয়ে তারা ভরসা করতে পারে। ওরা যদি এভাবে উন্নতি করতে থাকে, ভবিষ্যতে বিদেশের মাটিতে সাফল্য না পাওয়ার আমি কোনো কারণ দেখি না।’
এক জয়ে যত রেকর্ড বাংলাদেশের
নিজেদের ৩৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম ১ রানের মধ্যে প্রতিপক্ষের প্রথম ৩ উইকেট পেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এর আগে সর্বনিম্ন ৩ রানে পেয়েছিল প্রতিপক্ষের প্রথম ৩ উইকেট, ২০১৫ বিশ্বকাপে ক্যানবেরায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে।
৩৮ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১ রান তুলতেই প্রথম ৩ উইকেট খোয়াল নিউজিল্যান্ড। এর আগে ১৯৮৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ও ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে তাদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১ বা এর কম রানে প্রথম ৩ উইকেট হারানোর ঘটনা ৩১টি। এর ১২টিতে রানের খাতা খোলার আগেই ৩ উইকেট পড়েছে।
১২তম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টি–টোয়েন্টি জিতল বাংলাদেশ। আর কোনো দেশ প্রথম টি–টোয়েন্টি জিততে এত ম্যাচ খেলতে হয়নি বাংলাদেশকে। ১৭টি দেশে টি–টোয়েন্টি খেলা বাংলাদেশ এখনো জয়ের মুখ দেখেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৮ ম্যাচ), পাকিস্তান (৩) ও ইংল্যান্ডে (২)।
১৩৪/৯ ঘরের মাঠে টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের সর্বনিম্ন। আগের সর্বনিম্ন ১৪১/৪, ২০২১ সালে অকল্যান্ডে। ঠিক আগের ম্যাচেই ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড গড়ে কিউইরা।
৩/২৬ নিউজিল্যান্ডে টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সেরা বোলিং শরীফুল ইসলামের। আগের সেরা ৩/৩১, ২০১৭ সালে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে রুবেল হোসেনের।
প্রথম টি–টোয়েন্টিতে দু’দলের চার ব্যাটসম্যান ১৯ রান করেছেন। ২০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই প্রথম এক ম্যাচে তিনের বেশি ব্যাটসম্যান ১৯ রানে থামলেন।