অবন্তিকার আত্মহত্যা: সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর আটক

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ওরফে আম্মান সিদ্দিকীকে আটক করেছে পুলিশ।

শনিবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।

আম্মান সিদ্দিকী ও দ্বীন ইসলামকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। কুমিল্লা পুলিশের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হবে।

তবে গোয়েন্দারা তাদের কোথা থেকে এবং কখন নিজেদের হেফাজতে নিয়েছেন তা বলেননি তিনি।

অপর এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কুমিল্লা পুলিশের একটি দল ঢাকার পথে রয়েছে। আটক এ দুইজনকে তাদের কাছে হস্তান্তর করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

ফাইরুজ অবন্তিকা শুক্রবার রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও ‘পিসি পার্ক স্মরণিকা’ নামের ১০ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার বাসায় গলায় রশি বেঁধে ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর ১০ মিনিট পূর্বে নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে তিনি এ ঘটনার জন্য আম্মান সিদ্দিকী নামে তার এক সহপাঠীকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকেও এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন।

তিনি লেখেন, ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।’

অবন্তিকার মৃত্যুর খবর ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে তার সহপাঠীসহ শিক্ষার্থী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। শনিবার সকাল থেকেও ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। পরে এ ঘটনায় জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে সাময়িক অব্যাহতি ও শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে অভিযুক্ত করে আত্মহত্যার ঘটনায় সঠিক তথ্য জেনে সিদ্ধান্ত এবং মন্তব্য করার অনুরোধ করে বিবৃতিও দেন সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। ওই বিবৃতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা এবং তাদের জন্য কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শুধুমাত্র স্ট্যাটাসের ওপর ভিক্তি করে কাউকে ভুল না ভাবার অনুরোধ রইল। আমাদের স্নেহের শিক্ষার্থী অবন্তিকা হয়তো দীর্ঘদিন যাবৎ কোনো মানসিক চাপে ছিল। সেটা হয়তো তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য আমি সবিনয়ে প্রস্তুত। সঠিক তথ্য জেনে সিদ্ধান্ত এবং মন্তব্য করার অনুরোধ রইল।’

প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গুরা বাজার থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামে। তিনি রামচন্দ্রপুর রামকান্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে একই এলাকার অধ্যাপক আব্দুল মজিদ কলেজ ভর্তি হন। কলেজজীবনের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে ভর্তি হন। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ২০০৮-০৯ সালে ঢাবির মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। সে সময় হলের সভাপতি ছিলেন সাইদ মজুমদার, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জিয়াউল হায়দার তুহিন। 

ছাত্রজীবন শেষ হলে জবির ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন দ্বীন ইসলাম। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। 

অন্যদিকে, মোহাম্মদ রায়হান সিদ্দিকী আম্মানের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। ২০১৮-১৯ সেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির কার্যনির্বাহী সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফারাজির অনুসারী ও রেডিও প্রাইম নামে একটি এফএম রেডিওর জকি হিসেবে কাজ করতেন রায়হান সিদ্দিকী আম্মান। ২০১৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে।

এদিকে, অবন্তিকার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারসহ ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। শনিবার বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারা বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মানা না হলে, সোমবার (১৮ মার্চ) ভিসি কার্যালয় ঘেরাও করা হবে।

ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকাকে আপত্তিকর মন্তব্য করায়, মেয়েটি প্রতিবাদে হিসেবে আম্মানোকে চড় লাগাবে বলে। আম্মান নিজের অপরাধ ঢাকতে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে বলে অবন্তিকা তাকে চড় মারার কথা বলেছে। এবং এই এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে দ্বীন ইসলাম মেয়েটিকে ভিন্ন ভিন্ন সময় ৭ বার তার অফিসে তলব করে। এবং এ ধরনের মন্তব্য করে তাঁকে শাসায়, “খা**কি তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসস কেনো? তোরে যদি এখন আমার জুতা দিয়ে মারতে মারতে তোর ছাল তুলি তোরে এখন কে বাঁচাবে?” ঠিক এভাবেই অবন্তিকা তাঁর সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন।

উল্লেখ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষার্থীকে সহায়তায় জন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত কনসার্টে উপস্থাপনা করেছিলেন ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। কনসার্টে উপস্থিত হাজারো শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বার্তা দেন তিনি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে নিজেই আত্মহননের পথ বেছে নিলেন।

গতকাল শুক্রবার রাতে কুমিল্লা শহরে বাড়িতে আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন অবন্তিকা। তাতে সহপাঠীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে সহকারী একজন প্রক্টরের বিরুদ্ধে ছেলেটির পক্ষ নিয়ে তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগও করেছেন তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন অবন্তিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবন্তিকার বন্ধু ও সহপাঠীরা বলেছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রমে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অবন্তিকা উপস্থাপনা করতেন হাসিমুখে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *