আমার শহর বাগনান

:: আরিফুল হক ::

আমার শহর বাগনান। আমার বাল্যের শহর বাগনান। আমার কৈশোরের বেড়ে ওঠার শহর, তারুন্যের অনুপ্রেরনার শহর বাগনান। আমার খেলার সাথী, শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির সাথী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস যোগানোর সাথী এই বাগনান। এর প্রকৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষা, বরেন্য মানুষজন এবং বৈপ্লবিক ইতিহাসই আমাকে মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেরনা যুগিয়েছে।


বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার প্রাচীন ঐতিহ্য বিজড়িত একটি জনপদ এই বাগনান। এরই এক কিলোমিটার দূরে দামোদর নদীর পাড়ে মহাদেবপুর গ্রামই আমার জন্মপুর। হাওড়া রেলস্টেশন থেকে মাত্র ৪৫ কি:মি: দূরে (আগের বিএনআর) বর্তমানের দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের একটি প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন এই বাগনান, যা নির্মিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালের দিকে। এর পূর্বে দামোদর নদী (যে দামোদর ঈশ্বরচন্দ্র সাঁতরিয়ে পার হয়েছিলন বলে কথিত আছে) এবং পশ্চিমে রূপনারায়ন নদী। এই দুইনদীর বহমান পূন্যধারা ,বাগনানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপ লাবন্যের ফল্গুধারা হয়ে আজও বয়ে চলেছে। বাগনানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা শরৎ বাবু তাঁর শ্রীকান্ত উপন্যাসের ১ম পর্বে হুবহু তুলে ধরেছেন। শ্রীকান্ত পড়লে, আজও আমার বাল্যের সেই গ্রামকে চোখের সামনে দেখতে পাই ।


ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রাচীনকালে দামোদর এবং রূপনারায়ন নদী দুটি খুব কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। মাঝখানের চর এলাকাটা ছিল গভীর জংঙ্গলাকীর্ন ।যেখানে বাঘ, হরিন চিতা ময়াল ইত্যাদি পশু শ্বাপদের বসবাস ছিল। আগের রাজা জমিদাররা এখানে বাঘ শিকারে আসতেন ।প্রচুর বাঘ মারতেন এই জঙ্গলে। ‘নান’ একটি আরবী শব্দ । আরবীতে ‘নান’ বলা হয় মরু বা গড় কে। সুতরাং বাঘ এবং নান যুক্ত হয়ে এলাকার নাম হয়েছিল ‘বাঘনান’ যা পরবর্তীতে ‘বাগনান’ হয়ে যায়। আমার বাল্যবন্ধু নিমাই সুর এর মা ,আমায় দেখে একটা ছড়া বলতেন, দুলে,কাপালি,মুছুনমান এই তিন নিয়ে বাগনান । হেসে বলতেন, তুই একা হয়ে গেলি কেনরে বাবা! তোর মত আরও দু’ দশটা আরেফুল বানাইতে পারসনা ? সত্যি একসময় ‘দুলে’ অর্থাৎ মাছমারা ছিল যাদের পেশা ,আর কাপালি অর্থাৎ যারা পাট চাষের জনক, আর মুসলমানদের আধিক্য ছিল বাগনানে বেশী।


বাগনান বেশ কয়েকজন বিশ্ববরেন্য মুসলিম কৃতিসন্তান উপহার দিয়েছে। যার মধ্যে আছেন-

১) ডা: আবুল হুসেইন যিনি বাংলা ১২৬৯ সনে বাগনানে জন্মগ্রহন করেন। সেই আমলে তিনি প্রথমে ইংল্যান্ড ও পরে আমেরিকা থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় এম ডি ডিগ্রী লাভ করেন।তিনি একজন সুসাহিত্যিকও ছিলেন।


২) জাস্টিস সৈয়দ নাসিম আলী ইনি বাগনানের, বাইনান নামক গ্রামে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মসজিদের ইমাম। সৈয়দ নাসিম আলী নিজ মেধা এবং পরিশ্রমের ফলে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালে হাইকোর্ট এর বিচারক এবং ১৯৪৫সালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৪সালে সৈয়দ নাসিম আলিকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।


৩) জাস্টিস এস এ মাসুদ ইনি ছিলেন জাস্টিস নাসিম আলীর প্রথম পুত্র। সৈয়দ মাসুদ এবং পশ্চিমবাংলার মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একই সাথে একই বছর ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। সৈয়দ মাসুদ ১৯৭৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি শান্তিনিকেতনের ট্রেজারার ছিলেন। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে শান্তিনিকেতনে যাদের পড়তে পাঠানো হয়েছিল, তিনি তাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।


জাস্টিস সৈয়দ নাসিম আলীর আরেক পুত্র এস এ মনসুর, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্নের একজন সদস্য। তিনি কমরেড মুজফফর আহমদের সহযোগী ছিলেন, সেই সূত্রে আমার সাথে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল। জাস্টিস সৈয়দ নাসিম আলীর কনিষ্ঠ পুত্র, সৈয়দ মনজুর এলাহী বর্তমানে বাংলাদেশের একজন নামকরা ব্যবসায়ী। তবে উনিও ব্যরিস্টার।


৪) সাহিত্যিক আফসার আহমদ বাংলা সাহিত্যে, পতিত অবহেলিত মুসলিম সমাজের দরদী রূপকার আফসার আহমদ জন্মেছিলেন বাগনানের অন্তর্গত বাইনানের কড়ে বা কড়িয়া গ্রামে, ১৯৫৯ সালে। বাগনান ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ায় এই স্বনামখ্যাত সাহিত্যিকের সাথে আমার চাক্ষুষ পরিচয় কোনদিন হয়নি। তবে , কোন এক শারদীয় প্রত্রিকায় তাঁর ‘ঘর গেরস্থি’ উপন্যাসটি পড়ে এই হীরকখন্ডকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। পরে তাঁর ‘নিঁখোজ সেই মানুষটা’ পড়ার সুযোগ হয়। ২০১৭ সালে যেটা ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। তিনি মাত্র ৫৮ বছরের জীবনে, ৩০টির মত উপন্যাস ও অসংখ্য ছোট গল্প লিখেছন। আফসার আহমদের ‘ধান জোৎস্ন্যা’ অবলম্বনে চিত্রপরিচালক মৃনাল সেন নির্মান করেছিলেন ‘আপন ভুবন’ ছায়াছবি,  যেটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। আফসার আহমদ আপোসের সাথে বসবাস করতে শেখেনি, তাই দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে কঠিন লিভার সমস্যায় ভুগে ২০১৮ সালে পৃথিবী ছেড়ে নিঁখোজ হয়ে যান। রেখে যান স্ত্রী নাসিমা, পুত্র শতাব্দ আহমদ এবং কন্যা কুসুম হিয়াকে। জানিনা তারা এখন কোথায় আছে , কেমন আছে?


বাগনান বিখ্যাত হয়ে আছে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের স্মৃতি ধন্য হয়ে। বাগনান স্টেশন থেকে কয়েক কি:মি: দূরে রূপনারায়নের তীরে ,সামতাবেড় নামক গ্রামে ছিল শরৎচন্দ্রের বাড়ী। এখানেই রচিত হয়েছিল  শ্রীকান্ত, মেজ-দিদি, পল্লীসমাজ, বামুনের মেয়ে, রামের সুমতি প্রভৃতি অমর কথা সাহিত্যসমূহ ।

আমার শিক্ষাস্থল বাগনান হাই স্কুল একটি ঐতিহ্যশালী স্কুল, যেটা স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। আমার গ্রামের পাশের চন্দ্রপুর গ্রামের জমীদার হেমচন্দ্র ঘোষ এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

বাগনান সৌভাগ্যবান হয়ে আছে বেশ কিছু বিশ্বনন্দিত মহামানবের পদস্পর্শ পেয়ে। তাঁদের সবার কথা বিস্তারিত বলা যাবেনা। তবে কয়েকজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। বাগনানের আগুনসি গ্রামে জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগ দিতে অগ্নিযুগের অগ্নিকবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবার বাগনানে আসেন ১৯২৬ সালের জুন মাসে। তিনি বাগনান স্টেশন থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে, পায়ে হেঁটে, চার কি:মি: দূরের আগুনসি গ্রামে গিয়েছিলেন। বিভূতি ঘোষের কাছে শুনেছি কবি নাকি তাঁর উদাত্ত্ব আওয়াজে, মাইকবিহীন গলায়, ‘ওঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’ গানটি গেয়েছিলেন। কবি নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় এবং শেষবার বাগনানে এসেছিলেন আমাদের বাগনান হাই স্কুলের পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে, সম্ভবত ১৯৪০ সালের কোন এক সময়। ঐ অনুষ্ঠানে কবির হাত থেকে একটি বই উপহার নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।


নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু একটি সাড়াজাগানো পাবলিক মিটিং এ ভাষন দেবার জন্য প্রথম বাগনানে আসেন ১৯৪০ সালে। সভাটি হয়েছিল বর্তমান চিত্রবানী সিনেমার পশ্চিম পাশের পান আড়ত ময়দানে। এখানেই তিনি দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষনা করেছিলেন  ‘ভিক্ষা করে নয়, যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে’। বলেছিলেন ‘My Country men prepare for struggle’! নেতাজীও দ্বিতীয়বার বাগনান হাই স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। ক্ষুদিরামের মামার বাড়ী ছিল বাগনানের দেউল গ্রামে।


এই বাগনানেই একসাথে আন্দোলন সংগ্রাম, গণনাট্য আন্দোলন করেছি, বিশিষ্ট কবি, চিত্রকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা পূর্নেন্দু পত্রী, পুরাতত্ত্ববিদ তাঁরাপদ সাঁতরা, সংগীত শিল্পী মন্টু ঘোষ, হারাধন চক্রবর্তী, বাসন্তী ঘোষ, এতদ অঞ্চলের কম্যুনিজম আন্দোলনের প্রানপুরুষ সত্যেন চক্রবর্তী, নিরূপমা চ্যাটার্জি, অমল গাঙ্গুলি, আলী আনসার, নিমাই সুর প্রমূখের সাথে।


বাগনানে শিক্ষার হার ৬৮%, নারী ৬২% পুরুষ ৭০%, যেখানে ভারতের শিক্ষার হার মাত্র ৫৯.৫%।

বাগনানের অতীতের জয়গাথা লিখতে গেলে একটা পূর্নাঙ্গ বই লেখার প্রয়োজন। বাগনানের সাথে আমার বিচ্ছেদের কাল, কম করে হলেও ছয় যুগ হবে। এই অসুস্থতার যুগে জানিনা বাগনান কেমন আছে ! তবে আমার হৃদয়ে বাগনান আজও তার জবা আর গাঁদা ক্ষেতের মত রঙীন সাম্রাজ্য সাজিয়ে বিরাজ করছে।

লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *