কোয়ান্টাম ডট গবেষণা: রসায়নে নোবেল পেলেন ৩ জন

:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::

কোয়ান্টাম ডট সংশ্লেষণবিষয়ক গবেষণার জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ৩ বিজ্ঞানী। তারা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের মুঙ্গি বাওয়েন্ডি (Moungi G. Bawendi), লুইস ব্রুস (Louis Brus) এবং রাশিয়ার অ্যালেক্সি একিমোভ (Alexei Ekimov)।

বাংলাদেশ সময় বুধবার বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে সুইডেনের স্টকহোম থেকে এ বছরের রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস। 

অবশ্য এই নোবেল বিজয়ীদের নাম নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফাঁস হয়ে যায়। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণা বাকি ছিল।

নোবেল কমিটি জানিয়েছে, মুঙ্গি বাওয়েন্ডি ১৯৬১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) অধ্যাপনা করছেন।

লুইস ই ব্রুসের জন্ম ১৯৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের ক্লিভল্যান্ডে। তিনি বর্তমানে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।

অ্যালেক্সি একিমোভ ১৯৪৫ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিউইয়র্কের ন্যানোক্রিস্টালস টেকনোলজি ইনকরপোরেশনের সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী।

নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানীরা পাবেন একটি নোবেল মেডেল, একটি সনদপত্র এবং মোট ১১ মিলিয়ন বা ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা। চলতি বছর নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ মিলিয়ন ক্রোনা থেকে বাড়িয়ে ১১ মিলিয়ন করা হয়েছে। সে হিসেবে বর্তমান বাজারমূল্যে নোবেলজয়ীরা বাড়তি ৮৯ হাজার মার্কিন ডলার পাবেন। যেসব বিভাগে একাধিক নোবেলজয়ী থাকবেন, তাদের মধ্যে এই ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা ভাগ হয়ে যাবে। বর্তমান বাজারে এর মান প্রায় ১০ লাখ ৭ হাজার মার্কিন ডলার, বাংলাদেশী টাকায় হবে প্রায় ১১ কোটি ১৩ লাখ টাকার মতো (১ ডলার = ১১০.৭২ টাকা ধরে)। 

রসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের কাজ সেই ন্যানোর জগৎ নিয়ে। ন্যানোপ্রযুক্তিতে মৌলিক অবদান রেখেছেন তাঁরা। ন্যানোর জগতের উদ্ভট ঘটনাগুলো বোঝার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন অগ্রপথিক হিসাবে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে লুই ব্রুস ও আলেক্সি একিমোভ আলাদা আলাদাভাবে কোয়ান্টাম ডট তৈরি করেন। এগুলো অতিক্ষুদ্র ন্যানো কণা। এত ক্ষুদ্র যে এদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় কোয়ান্টাম প্রভাবের মাধ্যমে। এককথায় বলা যায়, যেসব ন্যানোকণা আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব দেখায়, সেগুলোই কোয়ান্টাম ডট।

এদিকে ১৯৯৩ সালে মুঙ্গি বাওয়েন্ডি এই কোয়ান্টাম ডট তৈরির প্রক্রিয়ায় বিপ্লব নিয়ে আসেন। ফলে এগুলোর গুণগত মান অনেক উন্নত হয়। আজকের দিনের ন্যানোপ্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য এ উন্নতি খুব জরুরি ছিল।

এবারের নোবেলজয়ীদের কল্যাণে মানুষ এখন ন্যানোজগতের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগাতে পারছে। বর্তমানে কোয়ান্টাম ডট ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক অনেক পণ্যে। ব্যবহৃত হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে।

তাত্ত্বিকভাবে বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোয়ান্টাম ডট বানানো সম্ভব। তাঁরা জানতেন, এগুলোর বৈশিষ্ট্য হবে অত্যন্ত অদ্ভুত। ১৯৩৭ সালে পদার্থবিদ হারবার্ট ফ্রোলিখ অনুমান করেন, ন্যানোকণার বৈশিষ্ট্য অন্য সাধারণ কণার মতো হবে না। তিনি তাত্ত্বিকভাবে এসব কণার বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য আরউইন শ্রোডিঙ্গারের কোয়ান্টাম সূত্রের কথা বলেন। তিনি বলেন, কণা যখন খুবই ছোট হয়ে যাবে আকারে, তখন ইলেকট্রনের জন্য জায়গা কমে যাবে। ফলে ইলেকট্রনকে অবস্থান করতে হবে খুব অল্প জায়গায়। অন্যান্য অতিপারমাণবিক কণার মতো ইলেকট্রনও একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গের ধর্ম দেখায়। ফলে ফ্রোলিখ ভাবলেন, এরকম অল্প জায়গায় এগুলোকে আটকে রাখলে তাদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাবে।

গবেষকরা এ কথা শুনে কাজে লেগে পড়লেন। গাণিতিকভাবে তাঁরা বিভিন্ন আকারের কণার জন্য কোয়ান্টাম প্রভাব কেমন হতে পারে, সে অনুমান করলেন। কিন্তু বাস্তবে এগুলো করে দেখতে গিয়ে দেখা গেল, বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। স্বাভাবিক। যে জিনিস বানাতে হবে, তার আকার তো একটা আলপিনের মাথার চেয়ে এক লাখ গুণ ছোট!

তবু ১৯৭০ দশকে এসে গবেষকরা এ ধরনের ন্যানোকাঠামো ঠিকই বানিয়ে ফেলেন। একধরনের আণবিক রশ্মি ব্যবহার করে তাঁরা বিভিন্ন পদার্থের ওপর পাতলা ন্যানো-আবরণ দেওয়ার উপায় বের করে ফেলেন। দেখা গেল, আবরণ কত পাতলা, তার ওপর এগুলোর আলোকবৈশিষ্ট্য (অপটিক্যাল প্রোপার্টি) নির্ভর করে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনুমানের সঙ্গে এ পর্যবেক্ষণ মিলে গেল।

বড় সাফল্য নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই পরীক্ষণের জন্য প্রয়োজন বেশ উন্নত প্রযুক্তি। গবেষকদের এ জন্য একদিকে প্রয়োজন ছিল অতিউচ্চ মানের ভ্যাকুয়াম এবং পরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা। কাজেই বেশিরভাগ মানুষ ধারণা করলেন, এসব কোয়ান্টাম বলবিদ্যাগত ঘটনা বাস্তবে তেমন কোনো কাজে লাগবে না।

কিন্তু বিজ্ঞানে বড় বড় বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে অপ্রত্যাশিতভাবে। এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। ন্যানোগবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দিল প্রাচীন এক উদ্ভাবন—কালারড গ্লাস বা রঙিন কাচ।

প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার থেকে শুরু হয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। সে হিসেবে এবার নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা শুরু হয় সোমবার থেকে। 

এর আগে ২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতেছেন তিনজন। তাঁরা হলেন অ্যালাইন আসপেক্ট, জন এফ ক্লসার ও আন্তন জেলিঙ্গার। ইনট্যাঙ্গলড ফোটনস, ভায়োলেশন অব বেল ইনইকুয়ালিটিস প্রতিষ্ঠা এবং কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁদের আবিষ্কার কোয়ান্টাম ইনফরমেশন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। তিনজনের মধ্যে বিজ্ঞানী অ্যালাইন আসপেক্ট ফরাসি, জন এফ ক্লসার মার্কিন এবং আন্তন জেলিঙ্গার অস্ট্রিয়ার নাগরিক। 

গতকাল চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ক্যাটালিন ক্যারিকো (Katalin Karikó) ও ড্রু ওয়েইসম্যান (Drew Weissman)। করোনার টিকা তৈরিতে অবদানের জন্য হাঙ্গেরি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিজ্ঞানী যৌথভাবে এবারের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল জিতে নিয়েছেন। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা। 

পুরস্কার হিসেবে তাঁরা দুজনে মিলে মোট ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রাউন বা ৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলার ভাগাভাগি করবেন। এর পরিমাণ বর্তমান বিনিময় হার (১ ডলার সমান ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা) অনুযায়ী প্রায় ১০ কোটি ৮২ লাখ ১৮ হাজার টাকা।  

প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি- এই ছয় বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন; তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কার প্রদানের পর তা উদযাপনে উৎসবের আয়োজন করে নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির সদর দফতর নরওয়েতে।

উনবিংশ শতাব্দিতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাজারে যা প্রায় ১৮০ কোটি ক্রোনের সমান। আলফ্রেড নোবেলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।

আগামীকাল মঙ্গলবার পদার্থে আর বুধবার রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। এরপর ৫ অক্টোবর সাহিত্যে আর ৬ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম জানা যাবে। দুই দিন বিরতি দিয়ে ৯ অক্টোবর ঘোষণা করা হবে অর্থনীতির নোবেল।

১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *