:: ক্রীড়া প্রতিবেদন ::
শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের মন্থর উইকেটে ১৮৬ রানে রোহিত-বিরাটদের আটকে দেন অভিজ্ঞ স্পিনার সাকিব আল হাসান ও দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নামা পেসার এবাদত হোসেন। ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লেও মেহেদি মিরাজের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত ১ উইকেটে জিতেছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
ভারতকে নাগালে পেয়েও ম্যাচটি হারতে বসেছিল বাংলাদেশ। শেষ উইকেটে করতে হতো ৫১ রান! মিরাজের সঙ্গী কেবল মুস্তাফিজুর রহমান! হারের প্রান্তে দাঁড়িয়ে শট খেলতে শুরু করেন মিরাজ। বাউন্ডারি মারতে গিয়ে ক্যাচও তুলে দেন তিনি। কিন্তু উইকেটরক্ষক কেএল রাহুল উপরে ওঠা মিরাজের ক্যাচ নয় যেন ম্যাচই ছেড়ে দেন। ওই মিরাজ ৩৯ বলে চারটি চার ও দুই ছক্কায় ৩৮ রানের ইনিংস খেলে চার ওভার থাকতে দলকে জয় এনে দিয়েছেন।
রোববার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে টস জিতে শুরুতে বোলিং করার বিষয়ে ভাবতে হয়নি নিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবালের ইনজুরিতে নেতৃত্বভার পাওয়া লিটন দাসের। বল হাতে ভালোও করেন দলের বোলাররা।
ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে ডানহাতি স্পিনার মেহেদি মিরাজ ব্রেক থ্রু দেন। তিনি তুলে নেন শিখর ধাওয়ানকে (৮)। অন্য ওপেনার রোহিত রান তুলছিলেন। তর সঙ্গে কোহলি সেট হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভারতীয় অধিনায়ক ২৭ রান করে ফেরায় ওই জুটি জমেনি। রান পাননি সাবেক অধিনায়ক কোহলিও। তিনি ফিরে যান ৯ রান করে।
বিপদে পড়া দলকে টানছিলেন শ্রেয়াস আয়ার ও কে এল রাহুল। এর মধ্যে চারে নামা আয়ার আউট হন ২৪ রান করে। ক্রিজে এসে দৃঢ়তা দেখাতে শুরু করেন ওয়াশিংটন সুন্দর। তিনি ৪৩ বল খেলে ১৯ রান করে ফিরে যান। পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে মাঠে আসা কেএল রাহুল দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৩ রানের ইনিংস খেলেন। নবম ব্যাটার হিসেবে ফিরে যাওয়ার আগে ৭০ বলে পাঁচটি চার ও চারটি ছক্কায় ওই রান তোলেন তিনি।
জবাব দিতে নেমে ইনিংসের প্রথম বলেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান ওপেনিং করতে নামা নাজমুল শান্ত। দলের ২৬ রানে ফেরেন তিনে নামা এনামুল হক। তিনি করেন ১৪ রান। ওই ধাক্কা ৪৪ রানের জুটি গড়ে সামলান লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান। লিটনের ব্যাট থেকে আসে ৬৩ বলে তিন চার ও এক ছক্কায় ৪১ রান। দলীয় শতকের আগে সাকিব আল হাসান ৩৮ বলে ২৯ রান করে সাজঘরের পথ ধরেন।
তবু ম্যাচ পক্ষে ছিল বাংলাদেশের। পাঁচে ও ছয়ে নামা দুই অভিজ্ঞ মিডল অর্ডার ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ ধীরে ব্যাটিং করলেও দলকে টানছিলেন। রিয়াদ ৩৫তম ওভারের শেষ বলে ৩৫ বলে ১৪ রান করে আউট হন। পরের বলেই বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন মুশফিক। তিনি করেন ৪৫ বলে ১৮ রান। দলের রান তখন ১২৮। জিততে দরকার ৫৯।
তখনও ম্যাচ হাতছাড়া হয়নি বাংলাদেশের। ক্রিজে ছিলেন আফিফ ও মেহেদি মিরাজ। কিন্তু বাঁ-হাতি আফিফ জুটি দিতে পারেননি। তিনি ৬ রান করে ফিরে যান। পরেই এবাদত এসে হিট উইকেট হন। পেসার হাসান মাহমুদও রানের খাতা খুলতে পারেননি। হারের চিন্তা মাথায় না নিয়ে মুস্তাফিজকে নিয়ে মিরাজ লড়াই চালিয়ে যান এবং ভক্তদের ভাসান জয়ের উল্লাসে।
এর আগে বাংলাদেশ দলের হয়ে ১০ ওভারে ৩৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন সাকিব আল হাসান। ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় স্পিনার হিসেবে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নামা পেসার এবাদত ৪৭ রান দিয়ে ৪ উইকেট তুলে নেন। ভারতের হয়ে মোহাম্মদ সিরাজ তিনটি এবং কুলদীপ সিং ও ওয়াশিংটন সুন্দর দুটি করে উইকেট নিয়েছেন। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ নিশ্চিতের ম্যাচে ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নামবে বাংলাদেশ।
বল হাতে দলের হয়ে ৯ উইকেট নিয়েছেন সাকিব আল হাসান ও এবাদত হোসেন। এর মধ্যে বাঁ-হাতি স্পিনার সাকিব তুলে নেন ৫ উইকেট। বাকি উইকেটটি নিয়েছেন মেহেদি মিরাজ। ওই উইকেট নিয়ে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপে প্রথম দাঁত বসান তিনি। ম্যাচ সেরা হওয়া মিরাজ বোলিং নিয়ে বলেন, ‘বল হাতে উইকেট টু উইকেট বল করার চেষ্টা করেছি কেবল।’
একবারও মনে হয়নি ম্যাচটা হারবো
জয় নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্পিন অলরাউন্ডার মিরাজ বলেন, ‘আমি সত্যি আনন্দিত এবং উচ্ছ্বসিত। ক্রিজে গিয়ে একটা সাইড ফোকাস করে খেলার পরিকল্পনা করেছিলাম। আত্মবিশ্বাস ছিল যে, ওই প্রান্তে বিশটির মতো বল খেলতে পারলে দলকে জেতাতে পারবো। এটা আমার কাছে স্মরণীয় এক পারফরম্যান্স।’
খেলা শেষে উচ্ছ্বসিত মিরাজ বলেন, আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই জয়ে আমি সত্যিই উচ্ছ্বসিত। ব্যাটিংয়ের সময় মোস্তাফিজুর ও আমি শুধু ভেবেছিলাম যে আমাদের বিশ্বাস রাখা দরকার। আমি তাকে শান্ত থাকতে বলেছি এবং ২০ বল খেলতে বলেছি।
ম্যাচ সেরার পুরস্করা জেতা মিরাজ আরও বলেন, আমি সত্যিই বোলিং উপভোগ করছি। দুপুরের উইকেটটা একটু কঠিন ছিল এবং আমি বোলিং উপভোগ করেছি। এই পারফরম্যান্স আমার জন্য সত্যিই স্মরণীয়।
ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল সত্যি কথা বলতে। অনেকে শুনলে হয়তো বলবে পাগল, হয়তো মনে করবে যে কিছু…। সত্যি বলতে আমি বিশ্বাস করছিলাম। আমার বিশ্বাস খুব ভালো ছিল। একবারও মনে হয়নি ম্যাচটা হারবো। শুধু একটা কথা বারবার বলছিলাম, আমার মনে যেটা চলছিল, আমি পারবো। বারবার নিজেকে বলেছি আমি পারবো, আমি পারবো। ’
মিরাজ ব্যাটিংয়ে এসেই হারিয়েছেন আফিফকে। এরপর তার লড়াই করতে হয়েছে বোলারদের নিয়ে। এর ওপর তিনি বেশিক্ষণ এবাদত হোসেন ও হাসান মাহমুদকে পাননি। তারা দুজন ফিরেছেন দুই রানের ভেতর। মিরাজের ভাবনায় ছিল ছোট ছোট জুটি গড়ার।
তিনি বলেছেন, ‘যখনই যে লাস্টের ব্যাটার ছিল- হাসানকেও একই কথা বলেছি যে চার-পাঁচটা বল যদি তুমি খেলতে পারো তাহলে আমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি যেভাবে চিন্তা করছিলাম হয়তো এবাদতকে নিয়ে ১৫ রান করবো, হাসানকে নিয়ে ২০ রান করবো। মোস্তাফিজকে নিয়ে শেষে ১৫-২০ রান যা লাগে, করবো। এভাবেই আমার চিন্তা ছিল। ’
‘কিন্তু তারপরও পরপর দুই উইকেট পড়ে গেছে। শেষ উইকেট যখন ছিল- তখন তো ডু অর ডাই। মানে হারানোর কিছু নাই। তখন তো ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকিটা এমন নিয়েছি… মোস্তাফিজের কথা খুব ভালো লেগেছে- ওর কথা কানে বাজছিল তখন নিজের মধ্যে নিজের বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। ’
ওয়ানডে নেতৃত্বের প্রথম ম্যাচেই জয়ের স্বাদ পেয়েছেন লিটন দাস
ওয়ানডে নেতৃত্বের প্রথম ম্যাচেই জয়ের স্বাদ পেয়েছেন লিটন দাস। তাও ভারতের মতো দলের বিপক্ষে। ম্যাচ শেষে তিনি জানান যে, শেষ মুহূর্তে ড্রেসিংরুমে বসে খুব নার্ভাস লাগছিল তার। অসাধারণ ইনিংস খেলেছেন মিরাজ। তার শেষ ৬-৭ ওভারের ব্যাটিং তিনি উপভোগ করেছেন।
ম্যাচ শেষে অধিনায়ক লিটন কুমার দাস বলেন, আমি যখন ড্রেসিং রুমে ছিলাম, আমি সত্যিই খুব নার্ভাস ছিলাম; কিন্তু মিরাজ-মোস্তাফিজ যেভাবে ব্যাটিং করেছে, আমি তাদের খেলা অনেক উপভোগ করেছি।
তামিম ইকবালের ইনজুরিতে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া লিটন আরও বলেন, আমি এবং সাকিব যখন উইকেটে ছিলাম তখন ভেবেছিলাম আমরা সহজেই জিতে যাব; কিন্তু আমরা যখন আউট হই, তখন ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যায়। অন্যদের ওপর আমার বিশ্বাস ছিল। এ জয়ের অনুভূতি প্রকাশে আমার কোনো ভাষা নেই, এটা আমাদের অবিশ্বাস্য এক জয়। মিরাজকে অভিনন্দন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত: ৪১.২ ওভারে ১৮৬/১০ রান (রাহুল ৭৩, রোহিত ২৭, স্রেয়াশ ২৪, কোহলি ৯, ধাওয়ান ৭; সাকিব ৫/৩৬, এবাদত ৪/৪৭)।
বাংলাদেশ: ৪৬ ওভারে ১৮৭/৯ রান (লিটন ৪১, মিরাজ ৩৮*, সাকিব ২৯, মুশফিক ১৮, মাহমুদউল্লাহ ১৪, এনামুল হক ১৪, মোস্তাফিজ ১০*; মোহাম্মদ সিরাজ ৩/৩২, কুলদীপ ২/৩৭, ওয়াশিংটন ২/১২)।
ফল: বাংলাদেশ ১ উইকেটে জয়ী।