সারাদেশে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি 

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

সারাদেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। শুক্রবার থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অর্থাৎ তিন দিন এটি অব্যাহত থাকতে পারে এবং তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। তাপপ্রবাহের কারনে আজ সারাদেশে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিকের স্বাক্ষরিত আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক সতর্কবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়তে পারে বলে সতর্কবার্তায় উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া আগামী ৩ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগসহ দিনাজপুর, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।

পূর্বাভাস বলছে, আজ সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে।

তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক এড়াতে সবাইকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সারাদেশে প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে কেউ অযথা ঘরের বাইরে যাবেন না। যারা বাইরে কাজ করেন অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণির মানুষরা পেটের দায়ে কাজ করেন। এই গরমের মধ্যে তারা যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে থাকেন তখন দেখা যাবে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে গেছে। তখন শরীরে কোন ঘাম থাকবে না। এমন হলে মাথাব্যথা, মাথা ঘুরানো, বমি বমি ভাব হতে পারে। তাতে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, যাকে বলা হয় হিট স্ট্রোক। এতে মৃত্যুও হতে পারে। এরজন্যই সতর্কতা হিসেবে হিট এলার্ট জারি করা হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকের জন্য একটাই উপদেশ অযথা ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা করবেন না। যেতে হলে ছাতা নিয়ে যাবেন। আর বাইরে কাজ করার সময় কিছুক্ষণ পরপর ছায়াযুক্ত স্থানে চলে আসতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বিশেষ করে লবণ দিয়ে পানি পান করলে ভালো হয়। ঘামের কারণে পানিশূন্যতার সঙ্গে লবণশূন্যতা হতে পারে। এজন্য প্রচুর পরিমাণ পানি, স্যালাইন, ডাব ইত্যাদি খেতে হবে। রাস্তাঘাটের আজেবাজে খাবার ও শরবত পান করা যাবে না। কেননা এতে জন্ডিসের মতো অসুখ বাসা বাধতে পারে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে কী ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয় এ সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, গরমে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় শিশু ও বৃদ্ধরা। এ সময় জ্বর, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ বেড়ে যায়। তা ছাড়া ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই ঘরের বাইরে বের হলে বা রোদে গেলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে, লেবুর শরবত, স্যালাইন ও তরল খাবার খেতে হবে। তেল-মশলাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। শরীরে দীর্ঘক্ষণ রোদ লাগানো যাবে না। বাইরে বের হওয়ার সময় ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে, সানগ্লাস ও ছাতা, মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করতে হবে। কিছুক্ষণ কাজ করার পর ছায়াযুক্ত স্থানে চলে যেতে হবে। একটানা কাজ করা যাবে না। এই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগামী মৌসুমে প্রত্যেককে একটি করে গাছ লাগাতে হবে এমন অঙ্গীকার পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে আসা দরকার।

এদিকে আবহাওয়াবিদ তরিকুল নেওয়াজ কবির জানান, আজ চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

চু্য়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজ বিকেল ৩টায় চুয়াডাঙ্গার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা তিন দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এ জেলায়।  

চু্য়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রায় খুব বেশি পার্থক্য না থাকায় অতিষ্ঠ এ অঞ্চলের জনজীবন।

প্রচণ্ড তাপদাহে এ অঞ্চলের হাসপাতালে বাড়ছে গরমজনিত রোগীর সংখ্যা। অসহনীয় গরমে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রয়োজনের তাগিদে ঘর থেকে বেরিয়েও কাজ করতে পারছে না তারা।

তীব্র তাপদাহে জনসাধারণকে সচেতন করতে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করে পথচারী ও এলাকাবাসীকে সতর্ক করছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, বাতাসের আদ্রতা বেড়ে যাওয়ায় বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। গত মঙ্গল ও বুধবার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়েছিল যথাক্রমে ৪০ দশমিক ৬ ও ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

গত বছরের ১৯ ও ২০ এপ্রিল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অতি তীব্র দাবদাহ। কাছাকাছি সময়ে বৃষ্টি না হলে গত বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে যেতে পারে।

এদিকে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে চলমান দাবদাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবি উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটির আগেই গরমে ছুটির দাবি করেছেন কেউ কেউ। 

দাবদাহের ব্যাপারে ইতিমধ্যে অধিদপ্তরে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান। তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গায় চলমান দাবদাহের বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। তবে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চুয়াডাঙ্গার ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের আশু মিয়া বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে মাঠে জমিতে কাজ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। ভ্যাপসা গরমে বেশিক্ষণ মাঠে অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জমিতে সেচ দেওয়ার পরও মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে।’

কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সুজন আলী বলেন, ‘সকালে কাজের জন্য অফিসে আসতে হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। সড়ক থেকে গরম উঠে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। বাইরে বেশি সময় অবস্থান করা যাচ্ছে না।’

উথলী গ্রামের শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘বারবার পানি পান করেও তৃষ্ণা মেটানো যাচ্ছে না। বৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে প্রতিদিন।’

এর আগে বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বুধবার ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মঙ্গলবার ছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

২০২৩ সালে ১৯ ও ২০ এপ্রিল জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গতকাল। আগেরদিন ৩৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বুধবার ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, ‘বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে, যা আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে।’ 

রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে নানা তথ্য জানিয়ে রাজশাহীর সড়কে মাইকিং করা হয়েছে। দিনের বেলায় জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের না পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। 

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালসহ বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ডায়রিয়া সহ সর্দি-কাশি ও জ্বরের রোগী বাড়ছে। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ভেতরে এবং বারান্দায় তিল ধারণের ঠাঁই নাই। একই চিত্র হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে। বহির্বিভাগেও শিশু ও মেডিসিন চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সিরিয়াল দেখা গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২০০ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

রামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, আবহওয়াজনিত কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। এই গরমে জ্বর সর্দি কাশি এবং ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে পারে এটা মাথায় রেখে হাসপাতালে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *