ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে ঢাকার ১৮টি ওয়ার্ড

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার দুই সিটির ১৮টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়েও বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে গত ১৭ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

মঙ্গলবার (২৮ মে) সকালে রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত মৌসুম পূর্ব এডিস সার্ভে-২০২৪ এর ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বীকৃত এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়।

দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো– ১২, ১৩, ২০, ৩৬, ৩১, ৩২, ১৭, ৩৩নং ওয়ার্ড। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো– ৪, ১৩, ৫২, ৫৪, ১৬, ৩, ৫, ১৫, ১৭, ২৩নং ওয়ার্ড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ১২নং ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে এডিসের ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ১৩নং ও ২০নং ওয়ার্ড, এগুলোতে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৪০ শতাংশ। ৩৬নং ওয়ার্ডে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৩১নং ও ৩২নং ওয়ার্ডে ৩০ শতাংশ, ১৭নং ও ৩৩নং ওয়ার্ডে ২৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে।

এছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ঢাকার সবচেয়ে বেশি ৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৪নং ওয়ার্ডে ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ৫২নং ও ৫৪নং ওয়ার্ডে ৩৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ১৬নং ওয়ার্ডে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে। এছাড়াও ৩নং, ৫নং, ১৫নং, ১৭নং এবং ২৩নং ওয়ার্ডে ৩০ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রতিবছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মৌসুম পূর্ব, মৌসুম, মৌসুম পরবর্তী তিনটি জরিপ পরিচালনা করে আসছে। তারই অংশ হিসেবে অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কীটতত্ত্ববিদদের ২১টি টিমের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৯৯টি ওয়ার্ডে ২১টি টিমের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। প্রতি ওয়ার্ড ৮টি ব্লকে ভাগ করে দুটি টিম ৪টি ব্লকে ১৫টি করে প্রতি ওয়ার্ডে ৩০টি বাড়িতে জরিপ পরিচালনা করেন। ১০ দিনে ৯৯টি ওয়ার্ডে সর্বমোট ৩১৫২টি বাড়িতে সার্ভে করা হয়। তাছাড়া যেসব ওয়ার্ডে বাড়ির সংখ্যা বেশি ও এলাকা বড় সেগুলোতে ৩-৫টি টিমের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়।

জরিপের ফলাফলে জানানো হয়, মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে প্লাস্টিকে ড্রামে ১৮ শতাংশ, মেঝেতে জমানো পানি ১৫ শতাংশ এবং বালতিতে জমানো পানিতে ১৪ শতাংশ চিহ্নিত হয়েছে।

জরিপ করা ৩১৫২টি বাড়ির মধ্যে ৪৬৩টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা ও পিউপা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে বহুতল ভবন ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, স্বতন্ত্র বাড়ি ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবন ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, সেমিপাকা বাড়ি ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও খালি জায়গা ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

ঢাকা উত্তর সিটিতে মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক ব্রুটো ইনডেক্স ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও হাউস ইনডেক্স ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়াও দক্ষিণ সিটিতে মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক ব্রুটো ইনডেক্স ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও হাউস ইনডেক্স ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সব পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অনুষ্ঠানে ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কারও একার কাজ নয়। এটার সঙ্গে যুক্ত সব কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক রোবেদ আমিন প্রমুখ।

২০২৩ সালের পুরোটা জুড়েই দেশবাসীকে ভুগিয়েছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ২৪ বছরের ডেঙ্গুর ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে গত বছর। 

অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৮৬৮ জন। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৮ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫ জন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, তেইশ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গিয়েছিল, শুধু ২০২৩ সালেই তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে। 

দেশের প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়।

এর পরে কয়েক বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ কিছুটা কম থাকলেও গত ৫ বছর ধরে ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু। 

২০০০ সালের পরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু ধীরে ধীরে কমে এলেও ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ। ২০১৯ সালে ১ লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।

২০২০ সালে করোনার প্রকোপের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *