সর্বশেষ সাক্ষাৎকার: মিনার মাহমুদ

:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::

দৈনিক মানবজমিনের সাপ্তাহিক প্রকাশনা জনতার চোখ সাংবাদিক মিনার মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করে। সেই সাক্ষাৎকার নাগরিক নিউজ অনলাইনের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল-

নব্বই দশকের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আলোচিত সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদ রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামী হয়েছেন, তার পত্রিকাও বন্ধ হয়েছে, তারই সাক্ষাৎকার নিয়েছে জনতার চোখ।

নব্বই দশকের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আলোচিত সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদ চলে গেছেন । একরাশ কষ্ট আর হতাশার রূপরেখা টেনে হোটেল রিজেন্সীর নিভৃত কক্ষে জীবনের ইতি টেনে চলে গেলেন অসীমে। জীবন যুদ্ধে পরাজিত এই সৎ সাহসী কলম যোদ্ধা দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে মিনার মাহমুদ দেশে ফিরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

সাক্ষাৎকারে এরশাদের পতনে কলম হাতে সেই সাহসী সৈনিক নব্বই এর গন অভ্যুত্থান পরবর্তি সরকারের চরম বিমাতা সুলভ আচরে হতাশ হয়ে প্রবাসে সেচ্ছা নির্বাসন, প্রবাসে দাসত্বের জীবন, আবার ফিরে আসাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন । জনতার চোখে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

জনতার চোখেঃ কোন পরিস্থিতিতে বিদেশ চলে গেলেন

মিনার মাহমুদঃ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ‘বিচিন্তা’ একটি বড় ভূমিকা পালন করলেও আমি দেশত্যাগ করি একানব্বইয়ের ডিসেম্বরে। তখন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার।

চাপের মুখেই তখন আমি দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার বিরুদ্ধে তখন পাঁচ-ছয়টি মামলা। দ্রুত বিচারের অধীনে সেই মামলার বিচার চলছিল।

আমার সব মামলা ছিল সাংবাদিকতা সম্পর্কিত। কোনটাই চুরি-ডাকাতির মামলা না। তবুও সমন জারি, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হওয়া। নানা রকম হয়রানি হতে হতো। সপ্তাহের সাতদিনই আমার কাটে আদালতের বারান্দায়। আমি কি সাংবাদিকতা করবো, অফিস করবো না আদালতে ঘরবাড়ি, থাকার বন্দোবস্ত করি। তা না হলে এগুলো ছেড়ে পালাই? এমন কোন অপরাধ বা অন্যায় তো করিনি যে দিনের পর দিন আমাকে আদালতে থাকতে হবে। মানুষ দেশ ছাড়ে ভাগ্য অন্বেষণে। আর আমাকে ভাগ্য ছেড়ে যেতে হয়েছে।

জনতার চোখঃ মামলা মোকাবিলার ভয় না মামলার হয়রানি থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেলেন

মিনার মাহমুদঃ বেশির ভাগ মামলা ছিল হয়রানিমূলক। কোন মামলাতেই আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায়নি। একটি মামলায় আমি দুঃখপ্রকাশ করেছি, অন্য একটি মামলাতে সামান্য জরিমানা হয়েছে মাত্র। মূলত হয়রানির জন্যই চলে গেলাম।

জনতার চোখঃ মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা কি?

মিনার মহমুদঃ জানি না। খোঁজও নিইনি।

জনতার চোখেঃ আপনি যে দেশ রেখে গিয়েছিলেন দুই দশক পরে ফিরে কেমন দেখছেন?

তসলিমা নাসরিনের সাথে বিয়ে প্রসংগেঃ

তসলিমা নাসরিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে প্রেম ও পরে বিবাহ সূত্রে মাঝেমধ্যে আমাদের আড্ডায় এসেছে। অল্প কিছুদিনের জন্য আমার বিবাহিত স্ত্রীও ছিলেন।

দু’জনের দু’রকম দৃষ্টিভঙ্গি আর দু’রকম আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণেই আমাদের সংসার বেশি দিন টেকেনি। আপনাদের সংসার কতদিন স্থায়ী ছিল? সাত-আট মাস। যে বছর আমি দেশ ত্যাগ করি সে বছরই অর্থাৎ একানব্বইয়ের।

ফেব্রুয়ারির দিকে আমাদের বিয়ে হয় আর ডিসেম্বরে দেশ ত্যাগের সময় আমাদের সেপারেশন হয়। পরে বিদেশ থেকেই আমাদের ডিভোর্স হয়।

জনতার চোখঃ আদর্শগত দ্বন্দ্ব বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন?

মিনার মাহমুদঃ তার লেখালেখিসহ জীবন-যাপনের অনেক কিছুর সঙ্গে আমি একমত আবার অনেক কিছুর সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করেছি। তসলিমা নাসরিন নিয়মিত ‘বিচিন্তা’য় লিখতেন। বিচিন্তাতেই কাজ করতেন অম্লান দেওয়ান। বর্তমানে বাংলাদেশস্থ ফরাসি দূতাবাসে কর্মরত অম্লানের অভ্যাস ছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লেখাপড়া করা। সে হঠাৎ তসলিমা নাসরিনের একটি লেখা আর ভারতের নারীবাদী লেখিকা সুকুমারী রায়ের একটি লেখা নিয়ে আসে। দুটো লেখা মিলিয়ে দেখা গেল তসলিমা নাসরিনের লেখাটি আর সুকুমারী রায়ের লেখা হুবহু এক। দাড়ি-কমাসহ। আকার-ইকারও কোন রকম বদলায়নি। এটাকে আমরা বলি চৌর্যবৃত্তি। তো তৎকালীন বিচিন্তায় তসলিমা নাসরিনের লেখাটি আর সুকুমারী রায়ের লেখা আমরা পাশাপাশি ছাপালাম। যা হয়- এখান থেকেই সাংসারিক ক্ষেত্রে আর আদর্শগত দিক থেকে আমাদের দ্বন্দ্বের সূচনা। আমি আসলে তখন বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি, আমি যখন সম্পাদক তখন সেখানে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে আমার দায়িত্বের এখতিয়ার অনেক বড়। এখতিয়ারই বলে যে, আমাকে লেখাটি ছাপাতে হবে।

অপরাধ যদি আমার ঘরে থাকে তবে আমি অন্যদের অপরাধ কিভাবে ছাপাবো। বিষয়টি তাকে বোঝাতে আমি ব্যর্থ হই। এটিকে সে অত্যন্ত অফেনসিভ হিসেবে নেয়। সে আমাকে বললো, আমি তার সঙ্গে শত্রুতা করেছি। আমি পাল্টা জবাবে বলেছিলাম, এটা রিয়েলিটি, তুমি নিজেই দেখ। তোমার নিজের লেখার পাবলিকেশন্স তারিখ আর সুকুমারী রায়ের লেখা ছাপা হয়েছে তিন-চার বছর আগে। চুরিটি ছিল খুবই কৌশলের চুরি-এটা প্রকাশিত না হলে কেউ জানতো না। পরে তসলিমা নাসরিনের প্রথম বই ‘নির্বাচিত কলামে’ও লেখাটি ছাপা হয়েছিল। যেদিন থেকে এ ঘটনা জানতে পারি সেদিন থেকে আমি তসলিমার লেখালেখির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। কারণ, একটি মৌলিক লেখা যা অন্যের তা কাট-পেস্ট করার কোন মানে হয় না। মূলত সেই থেকেই আমাদের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

জনতার চোখঃ তসলিমার লেখালেখি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

মিনার মাহমুদঃ প্রথম কথা, তসলিমা যা লেখেন তিনি নিজেই তা বিশ্বাস করেন না। তার সঙ্গে বসবাসের সুবাদে এটা আমি জেনেছি। তিনি নারী স্বাধীনতা আর নারী মুক্তির কথা বলেন, কিন্তু নিজে ব্যক্তিগতভাবে যে ধরনের আচরণ করেন, তাতে আমার মনে হয়েছে তিনি নিজেই নিজের লেখা বিশ্বাস করেন না। তার কোন দিকটি আপনাকে এমন মন্তব্য করতে উৎসাহ জোগালো? নারীরা এ দেশে মুক্তি পাক, নারীরা স্বাধীনতা পাক, তিনি জরায়ুর স্বাধীনতা চান, এটা চাইতেই পারেন। তার নিজের জরায়ুর স্বাধীনতা চাওয়া নিজের ব্যাপার। কিন্তু কথায় ও কাজের তো মিল থাকতে হবে। আমি বাইরে ধূমপান বিরোধী কথা বলছি, আর ঘরে ফিরে সমানে ধূমপান করছি। এটা কি স্ববিরোধী নয়।

তার সঙ্গে বসবাসের ফলে আমি এমন স্ববিরোধী নানা আচরণ খেয়াল করেছি। ও নিজেই আসলে নিজের লেখা বিশ্বাস করে না। মানুষ কিভাবে বিশ্বাস করবে। তার লেখালেখির বিষয়ে আমি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নই।

জনতার চোখঃ ‘বিচিন্তা’ সম্পর্কে

মিনার মাহমুদঃ’৮৭-র আন্দোলন যখন ব্যর্থ হয় তখন অবধারিতভাবেই বিচিন্তা বন্ধ হয়। সময়টা তখন ১৯৮৮-এর জানুয়ারি। এরশাদকে নিয়ে কাভার স্টোরি ছিল ‘গণঅভ্যুত্থান দিবসে গণহত্যা এবং নিরোর বাঁশি’। এটা ছিল চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গণহত্যাকে কেন্দ্র করে। কাকতালীয়ভাবে এরশাদ সেই গণহত্যার সময় ইতালি ছিলেন। সম্রাট নিরোকে কল্পনা করে আমরা এরশাদের হাতে তখন বাঁশি ধরিয়ে দিই। এর জন্য বিচিন্তা বন্ধ হয়। আমার বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু মামলা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় আমি প্রায় ৬ মাস অভিযুক্ত ছিলাম। পরে আমি বেকসুর খালাস পাই মামলা থেকে। পরে আবার এরশাদ পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে পত্রিকা আবারও প্রকাশ করতে পারি। এবারও ৯ মাস পত্রিকা প্রকাশের পর আমি দেশত্যাগ করি।

জনতার চোখেঃ তখন কি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে গেলেন না বিক্রি করে দিলেন?

মিনার মাহমুদঃ না বিক্রয়ের কথা যারা বলেন, তারা মিথ্যা বলেন। এটা অপপ্রচার। আমি দেশ ছাড়ার সময় ইউএনবির এনায়েতউল্লাহ খানের কাছে পত্রিকা হস্তান্তর করে যাই। তিনি দু’মাসের মতো পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।

তারপর আবার বন্ধ হয়ে যায়। দেশে ফিরে আমি যোগাযোগ করেছি, তিনি আমার পত্রিকা ফিরিয়ে দেয়ার সম্মতি জানিয়েছেন। বিচিন্তায় যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছে তারা সবাই এখন স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, দেশটিভির আমিনুর রশীদ, বৈশাখীর আমীরুল ফয়সল, জনকণ্ঠের ফজলুল বারী (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায়), তৃতীয় মাত্রার জিল্লুর রহমান, আরটিভির আনিস আলমগীর। এরা কোন না কোনভাবে বিচিন্তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এবং অনেকের কাজের শুরু বিচিন্তা থেকেই। আমি গৌরব বোধ করি যখন ভাবি, আমিও ছিলাম না, বিচিন্তাও নেই। কিন্তু সৃষ্টি তো রয়ে গেছে। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *